Ajker Patrika

বিনিয়োগ বাড়লেই নিয়োগ বাড়বে

বিরূপাক্ষ পাল
বিনিয়োগ বাড়লেই নিয়োগ বাড়বে

বাংলাদেশের অর্থনীতি কোভিড-পূর্ব সময়ে প্রায় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছুঁই ছুঁই করছিল। কিন্তু কোভিড-উত্তর অর্থনীতি মূলত ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে এক অনভিপ্রেত সংকটের মধ্যে পতিত হয়, যার পেছনে কোভিড বা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ—এর কোনোটিই দায়ী নয়। বিগত সরকারের নেতা বা কর্মীরা সে রকম যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করলেও অর্থনীতিবিদেরা তা গ্রহণ করেননি। কারণ, কোভিডের আগে থেকেই বাংলাদেশে দুটো সমস্যা দানা বাঁধছিল। এগুলো হলো: এক. ব্যাংকিক খাতের বর্ধমান খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি এবং দুই. ত্রুটিপূর্ণ বিনিময় হার বা কৃত্রিমভাবে ডলারের নিম্নমূল্য চালিয়ে রাখা। আন্তর্জাতিক লেনদেনে আজকের ডলার-সংকট ও রিজার্ভ ঘাটতি এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারল্যসংকট—এই দুই সমস্যারই বীজ বপন করা হয়েছিল কোভিড-পূর্ব সময়ে।

কোভিড সারা বিশ্বে মন্দা নামিয়ে দেয়। মন্দার একটি সুবিধা হচ্ছে, এ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিস্তেজ হয়ে আসে। কোভিড কমে যেতে থাকলে ২০২১ সাল থেকে আকস্মিকভাবে দীর্ঘ সময়ে চাপিয়ে রাখা চাহিদা সব দেশেই মাথাচাড়া দেয়। কিন্তু সেভাবে জোগানযন্ত্র প্রস্তুত ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে চাহিদার উচ্চ চাপে জোগানের শিকল ছিঁড়ে যায়। একে বিপণনশাস্ত্রের ভাষায় জোগান শিকলের বিভ্রাট বা ‘সাপ্লাই চেইন ডিজরাপশন’ বলে। এ সময় চাহিদার তুলনায় জোগান ক্ষমতার পশ্চাৎপদতায় একধরনের মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, কলকারখানা ও অফিস-আদালত দ্রুত হারে জেগে ওঠে। সৃষ্টি হয় অতিরিক্ত শ্রমচাহিদার, যা মজুরি বাড়িয়ে দিয়ে খরচতাড়িত মূল্যস্ফীতি বা ‘কস্ট-পুশ ইনফ্লেশন’ সৃষ্টি করে।

চলমান এই দুই ধরনের মূল্যস্ফীতি যেকোনো অর্থনৈতিক নবজাগরণের সঙ্গী—যা অর্থনীতির জন্য ততটা অকল্যাণকর নয়। কারণ, এ সময়ে মানুষের কাজের নানা ক্ষেত্র তৈরি হয়, বেকারত্ব কমে, উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং মজুরিও বাড়ে—যা বর্ধিত মূল্যস্ফীতিকে ছাপিয়ে যায়। তা ছাড়া জোগান বিঘ্নিত হওয়ায় যেটুকু মূল্যস্ফীতি জেগে ওঠে, তা আবার জোগান-কর্ম স্বাভাবিক হয়ে এলে ঝিমিয়ে পড়ে। তবে মজুরি বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি বেশ কিছুদিন বাজারে থেকেই যায়। সেটি স্বাভাবিক।

বিশ্বাঙ্গনে উদীয়মান অর্থনীতির চাকায় হঠাৎ করে কম্বল পেঁচিয়ে দিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলেন ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে। এতে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বেড়ে গেল। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেল ও পণ্যের জোগানে আরও বিঘ্ন সৃষ্টি হলো। মূল্যস্ফীতি বাড়তে লাগল মূলত জোগান-বিভ্রাট থেকে। এর সঙ্গে ভীতি থেকেও বেড়ে গেল প্রত্যাশাজনিত মূল্যস্ফীতি। সারা বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে সুদহার বাড়াতে থাকে। ঠিক এই সময়ে বাংলাদেশে বড়লোক ঋণগ্রহীতাকে সুবিধা দেওয়ার জন্য ‘বিনিয়োগ বাড়বে’ এমন অছিলায় সুদহারে ৯ শতাংশের টুপি পরিয়ে রাখা হয়। আমানতের ওপর দেওয়া হলো ৬ শতাংশের ছাদ। এই নয়-ছয় সুদহারের কাহিনি কোভিডের সময় শুরু হলেও কোভিড-উত্তর এটিই ছিল সবচেয়ে অসংগত সরকারি নীতি।

২০২২ সালে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। এমন সময়ে ৯ শতাংশের সুদহার বজায় রাখা মানে ধনিক গোষ্ঠী শতকরা শূন্য প্রকৃত সুদে ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকার ঋণ বের করে নিয়েছে। দৃশ্যমান সুদহার থেকে মূল্যস্ফীতি বিয়োগ করলে প্রকৃত সুদহার পাওয়া যায়। এই ঋণপ্রাপক সম্প্রদায় বাজারে তারল্য বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত উন্নয়ন প্রকল্পে জর্জরিত উচ্চাভিলাষী বাজেটে রাজস্ব সক্ষমতা দুর্বলতর হতে থাকে। ধনিক গোষ্ঠী কর দিতে পছন্দ করে না। এই দুর্বলতা কাটানোর জন্য সরকার উচ্চ ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে প্রচুর অর্থ তুলে নেয়—যা বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে আরও অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে ১২ শতাংশে উন্নীত করে। বাংলাদেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাজার অর্থনীতির বাস্তবতাবিমুখ সেই নয়-ছয় সুদটুপির শাস্তিমাত্র। তদপুরি বিগত সরকারের রাজস্ব অক্ষমতা রাজস্ব নীতির সংকোচনমূলক হাতিয়ারকেও নষ্ট করে দিয়েছে। এটি মূল্যস্ফীতিকে আরও চাঙা করেছে। এখানে মূল্যস্ফীতির প্রায় সবটাই সুদনীতির ভুল, ধনিকতুষ্টি ও রাজস্ব অক্ষমতা থেকে উৎসারিত। কোভিড বা পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের মতো অজুহাত শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রচেষ্টামাত্র।

সুদহার বাড়ানো হয়নি বলে বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রকৃত সুদহার বিদেশিদের কাছে অনাকর্ষণীয় হয়ে পড়ায় এক ধাক্কায় বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ বিলিয়ন বিনিয়োগ লেনদেনের ভারসাম্যের আর্থিক হিসাবকে অনেকটা শূন্য করে বাইরে চলে গেছে। সেই থেকে ২০২২-২৩ কালপর্বে অভূতপূর্ব রিজার্ভ-সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১০ দশকের মধ্যভাগে এবং এমনকি শেষ ভাগেও উচ্চ রিজার্ভ যেখানে বাংলাদেশের জন্য ছিল এক পরম স্বস্তির আসন, তা অল্প দিনের মধ্যেই এক দুশ্চিন্তার বিষয়ে পরিণত হলো। শক্তির অবয়ব বছর তিনেকের মধ্যেই সংকটের বিষণ্ন বদনে পরিণত হলো—যার সবটাই ছিল নীতিপ্রণেতাদের অদক্ষতা ও অবোধগম্যতার ফসল। নীতিকর্তারা বিশেষ করে এই সময়ের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নররা যে সমস্যাগুলো বুঝতেন না, তা নয়। বুঝতেন যে সুদহার বাড়ালে বড় ঋণগ্রহীতা অসন্তুষ্ট হন কিংবা খেলাপি ঋণের জন্য চাপ দিলে ধনিক গোষ্ঠী রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়। গলদ সেখানে।

সারা বিশ্বে যখন সুদহার বাড়ছিল, তখন সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শাস্ত্রসম্মত কোনো নীতিরই তোয়াক্কা করেনি। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান সঠিক নীতির পথে হেঁটে তাদের রিজার্ভ-সংকট ও মূল্যস্ফীতি—এ দুয়েরই অনেকটা সমাধান করে ফেলেছে। ভারতে মূল্যস্ফীতি এখন ৫ শতাংশের নিচে। অথচ বাংলাদেশে তা অনেক দিন ধরেই বেপরোয়াভাবে ১০ শতাংশের ওপর। ভারতের রিজার্ভ ৬৪০ বিলিয়নের ওপর। সে তুলনায় জিডিপির বিচারে বাংলাদেশের রিজার্ভ হওয়া উচিত কমপক্ষে ৮০ বিলিয়ন ডলার। অথচ এখানে তা ১৯-২০ বিলিয়নের ঘরে পড়ে আছে। কিংবা ক্রমাগত কমছে। আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। এটি হওয়ার কথা ছিল না। অর্থনীতির অর্জনকে এভাবে সংকটাপন্ন করা একধরনের অন্যায়।

এদিকে প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ডলারের বাজারভিত্তিক দাম কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চিত করতে পারেনি বলে এই ফারাক কাজে লাগিয়ে হুন্ডি ব্যবসা জমজমাট। বাইরে মুদ্রা পাচারের ক্ষেত্রে হুন্ডির ভূমিকা বেশ জোরালো। ডলারের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে সর্বদা কম থাকায় কিছু মানুষ ডলার গোপনে জমিয়ে রেখে পরে তা বিক্রি করে লাভ করতে পারে। কারণ, তারা জানে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম কমিয়ে রেখেছে বলে বাজারে ডলারের দাম বাড়তেই থাকবে—অনেকটা স্বর্ণের দামের মতো। ফাইন্যান্সের ভাষায় ‘আরবিট্রাজ’ বা দামভিন্নতা থেকে মুনাফা করার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এর নীতিজড়তা দিয়ে নিশ্চিত করে দিয়েছে। একবার বাজারের সঙ্গে ডলারের দাম সমন্বয় করে ফেললে এতে প্রাথমিক একটা ধাক্কা আসত। কিন্তু এতে হুন্ডি ব্যবসায়ী বা ডলারের মজুতদারেরা আর ব্যবসা করার সুযোগ ও পরিবেশ পেত না। সে পথে হাঁটা হয়নি ক্ষমতাধর আমদানিকারকদের সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে। এগুলো ছিল নীতির ভুল।

নীতি দিয়েও যে দুর্নীতি দমন করা যায়, তা আমাদের সে সময়ের নীতিনির্ধারকেরা কি জানতেন না? শুধু আনুগত্যের অন্বেষণে সরকার যদি শুধু অবসরপ্রাপ্ত আমলাকে সর্বত্র বসিয়ে রাখে, তাহলে মেধা, উদ্ভাবন বা দুর্যোগ মোকাবিলার প্রজ্ঞা মিলবে না। সে জন্য বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ও দূষিত হয়েছে। উদ্ভাবন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির সূচকের অবস্থাও তথৈবচ—এমনকি প্রতিবেশীদের তুলনায় অধিকাংশ সময়েই বাংলাদেশ পিছিয়ে। শিক্ষার যথাযথ মর্যাদা বা বিশেষজ্ঞের সম্মান পেছনে পড়ে থাকে। অগ্রাধিকার পায় রাজনৈতিক বিবেচনা ও আমলাদের কাঙ্ক্ষিত ছক। একশ্রেণির আমলা ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীর হাতে নীতিনির্ধারণের কাজ, সংসদ নির্বাচন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা এক বন্দিদশায় নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে। 

২০১০ দশকের মধ্যভাগে সরকারের উন্নয়নদর্শন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সরকার ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন ও জ্বালানি-সংকটের সমাধানে মনোযোগী হয়, যার ফসল জনগণ এখন ভোগ করছে। পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প এ দেশের জন্য ছিল স্বপ্নাতীত। কিন্তু সমস্যা বাধিয়ে দিয়েছে ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ব্যবসায়ীপ্রধান সংসদের দ্বারা অনুমোদিত ব্যাংকিং খাতের পারিবারিকীকরণ, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন, ভুল সুদনীতি ও অ-বাজারীয় বিনিময় হার বজায় রাখা, ধনিকতুষ্টির স্বার্থে করকাঠামো ও প্রশাসনকে ব্যবহার, কর ফাঁকিকে শাস্তিযোগ্য না করা, স্বেচ্ছাকৃত খেলাপি ও শেয়ারবাজারের অনাচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া এবং সর্বোপরি বিচার বিভাগের মন্থরতম গতি। অবকাঠামোতে মান ও অপচয়—এ দুই-ই বেড়েছে; কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল নেতৃত্বে অধঃপতিত হয়েছে। শিক্ষকদের রাজনীতিতে অতি উৎসাহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানকেও দাবিয়ে দিয়েছে।

কালোটাকা সাদা করার সরকারি কসরত ব্যবসা ও আয় উপার্জনে নৈতিকতাকে নিরুৎসাহিত করেছে। তাই উন্নয়নের ঘোটক রোগাক্রান্ত। স্বাস্থ্য বাড়া ভালো, কিন্তু তার সঙ্গে কোলেস্টেরল বাড়লে উচ্চ রক্তচাপ হয়। স্বাস্থ্যবানেরও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এ রকম একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে।

তাহলে উত্তরণের পথ কী—সেকথা ভাবার আগে সমস্যার স্বীকৃতি দরকার। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন যে জনসংখ্যার উচ্চ প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের সব চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেবে। তাই তিনি জনসংখ্যার অপরিকল্পিত প্রবৃদ্ধিকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে দূরদর্শী ও সফল গণনীতি। আজ বাংলাদেশের প্রধান দুই সমস্যা হচ্ছে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। হালে মূল্যস্ফীতি হয়তো কেটে যাবে, কিন্তু নিরন্তর সমস্যা হিসেবে থেকে যাবে বেকারত্ব। কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে মূল দায়িত্ব কাঁধে নেবে ব্যক্তি খাত। এখানে বিনিয়োগ বাড়লেই নিয়োগ বাড়বে। কিন্তু তার জন্য চাই একটি সুস্থ ব্যাংকিং খাত, যা অনেকটা নষ্টনীড়ে পরিণত হয়েছে।

লেখক: বিরূপাক্ষ পাল
অর্থনীতির অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত