Ajker Patrika

‘উত্তর আধুনিক’ পরীক্ষার্থী

সাজিদ মোহন
আপডেট : ৩০ মে ২০২২, ১০: ২৪
‘উত্তর  আধুনিক’  পরীক্ষার্থী

প্রস্তুতি না নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে যাওয়া পরীক্ষার্থীদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ পরীক্ষাভীতি—ফেল করার আশঙ্কা। ভয়কে জয় করতে যুগ যুগ ধরে ‘সৃজনশীল পরীক্ষার্থীরা’ আশ্রয় নিয়েছেন অভিনব সব কৌশলের। সচরাচর আমরা যাকে নকল বা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন বলে জানি।

না দেখলেও বড়দের মুখে শুনেছি পরীক্ষায় নকল করার সনাতন সব কৌশলের গল্প। হাতের মুঠোয় পুরে রাখা যায় এমন সাইজের বই গোপনে বিক্রি হতো একটা সময়। লুকিয়ে পরীক্ষার হলে নেওয়া হতো মিনি সাইজের সেসব গাইড বই। শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সম্পূর্ণ গাইড বা গাইডের ছেঁড়া পাতা থেকে দেখে দেখে লিখে পরীক্ষায় পাস করতেন অনেক শিক্ষার্থী। জামাকাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে, ছোট কাগজে ছোট অক্ষরে, ব্লেড দিয়ে বেঞ্চ চেঁছে উত্তর লিখে, বাথরুমে বই বা গাইড রেখে আসা ছিল নকলের কিছু জনপ্রিয় পদ্ধতি। দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে উৎসবের আমেজে, নানা রকম চুক্তিতে শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সম্মিলিত অংশগ্রহণে পরীক্ষা নামক লোকদেখানো নাটকের মঞ্চায়ন হতো কোনো রাখঢাক না রেখে।

দেখে দেখে লিখে, অর্থাৎ নকল করে পাস করেছেন তো কী হয়েছে! যাঁরা মুখস্থ লিখে পাস করেছেন, তাঁরাও তো নকল করেছেন! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মুখস্থ করিয়া পাশ করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, সেই-বা কম কী করিল?’ (শিক্ষার বাহন, শিক্ষা)

যুগ যুগ ধরে নকল ছিল, নকল আছে। পার্থক্য শুধু নকল করার পদ্ধতিতে। বর্তমানে সনাতন মিনি গাইড, ছোট কাগজে ছোট অক্ষরের নকল কৌশলের জায়গা দখল করে নিয়েছে মিনি প্রযুক্তি। পরীক্ষার্থীরা কানের ভেতর ক্ষুদ্র ইয়ারফোন ঢুকিয়ে, স্যান্ডেলের মধ্যে ব্লুটুথ ডিভাইস লাগিয়ে, স্মার্টগ্লাসে (চশমায়) বসানো ক্যামেরার সাহায্যে পরীক্ষার হলের বাইরে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দিয়ে স্মার্টওয়াচের সাহায্যে বাইরে থেকে পাঠানো প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে পরীক্ষা দেন। ‘অগ্রসর’ পরীক্ষার্থীদের কেউ কেউ আবার এসব প্রযুক্তি ও ডিভাইসের ঝামেলায় যেতে আগ্রহী নন। ধরা পড়ে সম্মান হারানোর ভয় থাকে। পরীক্ষার হলে চোর-পুলিশ খেলা তাঁদের সঙ্গে যায় না। পরীক্ষার আগেই টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন তাঁরা।

বিবর্তনবাদে বিশ্বাসীরা বলেন, পৃথিবীর সবকিছুই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। সনাতন ‘নকল পদ্ধতি’ বিতর্কিত হয়ে বাজারে এসেছে নকলের আধুনিক সংস্করণ। পরীক্ষায় কেউ কেউ বই দেখে উত্তর লিখে পাস করতে চান, কেউ কেউ পাস করতে চান প্রযুক্তির সহায়তায়, কেউ কেউ প্রশ্নপত্র পেতে চান পরীক্ষার আগেই। আবার কেউ কেউ এসব পদ্ধতির একটিও অবলম্বন না করে, পরীক্ষার হলে না গিয়েই পাস করতে চান। তাঁদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। প্রবেশপত্রে ফটোশপ প্রযুক্তির সহায়তায় ছবি টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে একজনের প্রক্সি পরীক্ষা আরেকজন দিয়ে বীরদর্পে পাস করে আসার অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে।

নকলের তথা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের বিবর্তনের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ ধাপটি রীতিমতো বিস্ময়কর! কিছুদিন আগে বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের অধীনে এক পরীক্ষায় শিক্ষকের উপস্থিতিতে পরীক্ষা

র হল থেকে ফেসবুক লাইভে আসেন এক ছাত্র। তখন তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের পরীক্ষা চলছে, সবাই লিখছে, আমি বসে আছি। স্যাররা এ প্লাস না দিলে বোর্ড-মোড ভেঙে ফেলবানে। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল পরীক্ষার হল থেকে ফেসবুকে লাইভ দেব। ম্যাডামও দেখি আমার ভিডিও করছে। ম্যাডাম, আপনি কিছু বলেন আমার লাইভে…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।‘উত্তর আধুনিক’ জনৈক ছাত্রটি পরীক্ষায় অসদুপায়ের সনাতন বা আধুনিক পদ্ধতির একটিও অবলম্বন করতে চাননি। তিনি পরীক্ষার উত্তরপত্রে কিছু লিখতে চান না। দিতে চান না পরীক্ষাও। পরীক্ষা না দিয়েই এ প্লাস পেতে চান।

না জানি এমন আরও কত পদ্ধতি বের হবে আর আমাদের অবাক হতে হবে!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত