Ajker Patrika

ঝিনাইদহে শরিফা ফলের বাণিজ্যিক চাষ

শাইখ সিরাজ
ঝিনাইদহে শরিফা ফলের বাণিজ্যিক চাষ

আতাফল আর শরিফা ফল কি এক? যদি এক না হয়, তবে কোনটি শরিফা আর কোনটি আতা? উদ্যানতত্ত্ববিদ ড. মেহেদী মাসুদ জানালেন, আতা ও শরিফা উভয়ই হলো অ্যানোনেসি পরিবারভুক্ত একধরনের যৌগিক ফল। ফল দুটির গাছ, পাতা, ফুল কাছাকাছি হলেও ফলে ভিন্নতা আছে। যে ফলটির চামড়ায় গুটি গুটি চোখ আছে, সেটির নাম শরিফা। আর আতাফলের ত্বক মসৃণ। কোনটি আতা আর কোনটি শরিফা, সে দ্বন্দ্ব দূরে থাক। এ ফলটি গ্রামবাংলায় কদাচিৎ দেখা যেত। আমরা শৈশবে বার্ষিক পরীক্ষার পর যখন গ্রামে নানুবাড়ি বেড়াতে গিয়েছি, তখন কারও কারও বাড়িতে আতা বা শরিফার গাছ দেখেছি। গাছ থেকে আধা পাকা ফল পেড়ে, তা পাকার জন্য রেখে দিতাম চালের ড্রামে। শুধু আতা বা শরিফাই নয়, ডেউয়া, গাব ইত্যাদি ফল গাছে গাছে ফলে থাকতে দেখতাম। আতার চাহিদা থাকলেও ডেউয়া বা গাব কেউ খেত না। গাছের নিচে ফল পড়ে থাকত। সে সময় ঢাকার খিলগাঁওয়ে এমন অসংখ্য ফলের গাছ ছিল। প্রাকৃতিকভাবেই জন্মানো এই সব ফলের গাছ থেকে ফল পেড়ে নিত এলাকাবাসী। সেসব ফলের বাণিজ্যিক চাষের কথা কেউ কখনো ভাবেনি।

আজকাল বাণিজ্যিকভাবে ফল-ফসল উৎপাদনে দেশের অনেক কৃষকই বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছেন। জমির সদ্ব্যবহার আর অর্থের হিসাবটিই এর সবচেয়ে বড় কারণ। ফলে গোটা দেশেই বৈচিত্র্যময় ফসল দেখা যায়। ফল উৎপাদন করে কৃষক তাঁর নিজের নামও যুক্ত করে নিয়েছেন ফলের সঙ্গে। যেমন পেঁপে বাদশা, পেয়ারা আতিক, কুল সিরাজুল, আম কাশেম, মাল্টা বাবুল, খেজুর মোতালেব, লিচু কিতাব, কলা কাদের। নামগুলো মোটেও কাল্পনিক নয়। দেশের প্রায় সব ফলচাষি এই নামগুলোর সঙ্গে পরিচিত। 

আশির দশকে পাবনার ঈশ্বরদীর সলিমপুর গ্রামের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মো. শাহজাহান আলী বাদশা বেকারত্ব দূরীকরণের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কৃষিকাজ। মাত্র আড়াই বিঘা জমিতে শুরু করেন আধুনিক ফল-ফসলের এক সমন্বিত কৃষি খামার। এরপর পেঁপে চাষ করে খুব অল্প সময়ে অর্থ আর খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। এখন ২০০ বিঘা আয়তনের এক বিশাল কৃষি খামারের অধিকর্তা তিনি। সবার কাছে পেঁপে বাদশা নামেই পরিচিত। 

কৃষি ডিপ্লোমা করেও কোনো চাকরি না পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আতিক আজ থেকে ১০ বছর আগে মাত্র ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে শুরু করেছিলেন পেয়ারাবাগান। পেয়ারার চাষ তাঁর ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এখন তাঁর বাগানের পরিধি ২৭০ বিঘার মতো। তাঁর এই সাফল্য দেখে ওই এলাকায় বহু তরুণ যুক্ত হয়েছেন পেয়ারার চাষে। ফলে নাটোর-রাজশাহী এলাকায় অর্থকরী ফসলের অন্যতম জায়গায় পৌঁছে গেছে থাই পেয়ারা। এ রকম গল্পই কাশেম, বাবুল কিংবা কাদেরের। ফল চাষ পাল্টে দিয়েছে তাঁদের জীবনের গল্প। 

সারা দেশে এমন কৃষকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই কৃষকদের সাফল্যের পেছনে নেই কোনো অলৌকিক আলাদিনের চেরাগ। বুদ্ধি আর শ্রমেই গড়েছেন তাঁদের নিজ নিজ সাম্রাজ্য। তাঁদের হাত ধরেই বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে সফলতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এই সাফল্যে ফলচাষিদের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এক যুগে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২২ শতাংশ। কম জমিতে বেশি মানুষের দেশ হিসেবে ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়ও এখন আমরা। আবার ফল চাষের জমি বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। এই হিসাবে, বছরে ফল চাষের জমি বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, দেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও দ্বিগুণ হয়েছে এক যুগে। ২০০৬ সালের এক হিসাবে, বাংলাদেশের মানুষ গড়ে দিনে প্রায় ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত। বর্তমানের হিসাবে সেটি প্রায় ৮৫ গ্রামে উন্নীত হয়েছে, যা দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং নিরাপদ পুষ্টি গ্রহণ অবস্থার উন্নয়নের একটি বার্তা। পাশাপাশি বেড়েছে ফলের আমদানিও। ফলের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে এবং ফলচাষিদের উৎসাহী করতে আমদানি কমানো উচিত। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। 

দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, লিচু ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ফল উৎপাদনের চিত্র দেখিনি। অথচ গত দুই দশকে নতুন নতুন ফল-ফসলে বদলে যাওয়া বহু এলাকার চিত্র দেখছি। কৃষক, উদ্যোক্তাদের মাল্টা, ড্রাগন, পেয়ারা, কুল, কমলা, লটকন ও অ্যাভোকাডোর মতো পুষ্টিকর ফল উৎপাদনে সফল হয়েছেন অনেকে। 

এই তালিকায় সাম্প্রতিক সময়ে শরিফা ফল যুক্ত হয়েছে। স্বল্প প্রচলিত বা একসময় একেবারেই বাড়ির আঙিনায় উৎপাদিত ফল শরিফার অল্পবিস্তরে বাণিজ্যিক চাষও শুরু হয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে, মাত্রই দুয়েকজন উদ্যোক্তা বাণিজ্যিক আকারে বাগান শুরু করেছে।

তারপরও ছোট-বড় সব মিলে দেশে আনুমানিক ১০০ একরের মতো জায়গায় শরিফা ফল উৎপাদন হচ্ছে। যার মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার মানিকদিঘি গ্রামের তরুণ শফিক মণ্ডল গড়ে তুলেছেন শরিফার বাণিজ্যিক বাগান। শফিক ২০১৪ সালে শুরু করেছিলেন বাগানের কাজ। পৈতৃক জমির গতানুগতিক ফল-ফসল আবাদের প্রথা ভেঙে উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে তিনি ৩ বিঘা জমিতে ৫০০টি শরিফাগাছের চারা রোপণ করেছিলেন। এখান থেকে তিন বছর পরই সাফল্য আসতে শুরু করে। শরিফা ফলের আশানুরূপ ফলন তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। 

শফিক মণ্ডল জানালেন, শরিফা ফল আকারে বড় ও পরিপক্ব হলেই ক্রেতার কাছে চাহিদা বাড়ে, মূল্যও বেশি পাওয়া যায়। বাগানে যে ফল আছে তার আকার খুব একটা বড় নয়, মাঝারি আকারের। তারপরও তিন থেকে চারটা ফলেই এক কেজি ওজন হয়। যার বর্তমান পাইকারি বাজারমূল্য প্রতি কেজি সাড়ে তিন শ টাকা।

শফিকের শুধু শরিফার বাগান নয়, এর বাইরে পাঁচ বিঘা মাল্টা, পাঁচ বিঘা ড্রাগন ও দশ বিঘার পেয়ারাবাগান রয়েছে। সব মিলে একজন সফল ফলচাষি তিনি। 

সারা দেশের অসংখ্য কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত দিয়েই রচিত হচ্ছে কৃষি খাতের নানা রকম সফল ঘটনা। এই সব সাফল্য যে শুধু বাণিজ্যের মোহে ঘটছে তা বলা যাবে না; বরং মাটি আর ফল-ফসলকে ভালোবেসেই তাঁরা কৃষিতে যুক্ত হয়ে দৃষ্টান্ত গড়ছেন। আমিও বিশ্বাস করি, শফিকের মতো এমন তরুণ উদ্যোক্তা কিংবা একেকজন উদ্যোগী কৃষকের সফল ঘটনাগুলোই বাংলাদেশে ফলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দিতে পারে। ফলে কমে আসবে বিভিন্ন ফলের আমদানি। তবে যাঁরা নতুন করে উদ্যোগ নেবেন, তাঁরা যেন অবশ্যই নতুন ফসল সম্পর্কে ভালোমতো জেনে-বুঝে এবং এর বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে তারপর উদ্যোগ নেন। 

শরিফা কিংবা আতা আমাদের কাছে নতুন কোনো ফল নয়। যুগ যুগ ধরে আমাদের বসতভিটায় কিংবা আশপাশে উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে বাণিজ্যিক গুরুত্বে এর ভালো মানের জাত নির্বাচন করে এখন অনেকেই বাণিজ্যিক বাগান গড়ছেন। অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট শরিফা ফল লাভজনক হওয়ায় দেশে অনেকেই এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব দিচ্ছে। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের শফিক মণ্ডলের সাফল্যও অনেককেই অনুপ্রাণিত করবে। তবে এ ক্ষেত্রে আগ্রহী উদ্যোক্তাকে অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এর চাষ ব্যবস্থাপনা, পরিচর্যা ও বাজার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে-বুঝেই চাষে নামতে হবে; বিশেষ করে যে মাটি ও আবহাওয়ায় শরিফা চাষে উদ্যোগ নেবেন তা কতটা নির্বাচিত ফল চাষের জন্য অনুকূল, সে-সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘জনতার জন্য হিজাব আইন, খামেনির উপদেষ্টার মেয়ের জন্য ডানাকাটা জামা’

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করবে: আমীর খসরু

সিটি করপোরেশন হচ্ছে সাভার

নির্বাচনের আগে প্রশাসনে রদবদল তাঁর তত্ত্বাবধানেই, যোগ্যদেরকে ডিসি নিয়োগ— বিএনপিকে প্রধান উপদেষ্টা

বিএনপির ক্লাবঘরে হামলা: জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি ভাঙচুর

এলাকার খবর
Loading...