Ajker Patrika

১৫ দিন ধরে বিদ্যুৎহীন টিলার ১০০টি পরিবার

কাজল সরকার, হবিগঞ্জ
আপডেট : ১০ জুন ২০২২, ১৫: ৪৫
১৫ দিন ধরে বিদ্যুৎহীন  টিলার ১০০টি পরিবার

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুড়ি বন বিটের কালিগজিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে বন বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগের। ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার আইন নেই’ দাবি করে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বন বিভাগ। এতে ওই এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১০০ পরিবার ১৫ দিন ধরে রয়েছে অন্ধকারে।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বন বিভাগ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। যদিও ওই এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগের তিন বছর পর কেন বেঁকে বসেছে বন বিভাগ, সেটি স্পষ্ট নয় বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে।

হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাহুবল আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে জানা যায়, বাহুবল উপজেলার পুটিজুড়ি বন বিটের ‘মধুপুর হিল রিজার্ভ ফরেস্ট’র দুর্গম পাহাড়ি এলাকা কালিগজিয়া। সেখানে দুটি টিলার পরও ৩০০ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবারের বাস। ২০১৮ সালের শেষের দিকে কালিগজিয়ার ১০০টি পরিবারকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাহুবল আঞ্চলিক কার্যালয়। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।

এদিকে ২০২০ সালে পুটিজুড়ি বন বিট কার্যালয়ও একটি সংযোগ নেয়। সম্প্রতি ওই এলাকার ২ নম্বর টিলায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি খুঁটি বসানোর কাজ শুরু করলে বাধা দেয় বন বিভাগ। একপর্যায়ে তারা ২০২১ সালের প্রথম দিকে জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাহুবল আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (ওএন্ডএম) মো. শহীদ উল্লাহর নাম উল্লেখ করে তিনজনের বিরুদ্ধে জেলা বন আদালতে মামলা করেন পুটিজুড়ি বন বিটের তৎকালীন বিট কর্মকর্তা জুয়েল রানা। মামলায় বনের প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টাকা ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়।

চলতি বছরের ২৬ মে আসামিদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগ ২৫ মে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।

এতে গত ১৫ দিন ওই এলাকার ১০০টি পরিবার অন্ধকারে রয়েছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এ ছাড়া সেখানে গড়ে ওঠা তাঁতপল্লিতেও প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন না নারীরা।

কালিগজিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুনীল দেববর্মা বলেন, ‘তিন বছর আগে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। তখন বন বিভাগ কোনো বাধা দেয়নি। এখন বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে বন বিভাগের ঝামেলা হওয়ায় তারা মামলা করছে। এতে আমাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে রেখেছে।’

গৌতম দেববর্মা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দেশের একটি পরিবারও অন্ধকারে থাকবে না। তাহলে আমরা কেন বিদ্যুৎ পাব না। আমরা তো এই এলাকায় শত শত বছর ধরে বসবাস করছি। আমরা কি এ দেশের নাগরিক না?’

ওই গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী পায়েল দেববর্মা বলে, ‘এই গ্রাম থেকে এবার ১২ জন এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা দেব। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ না থাকায় লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে।’

কালিগজিয়া আদিবাসী মহিলা সমিতির সভাপতি স্বপ্না দেববর্মা বলেন, ‘বিদ্যুৎ আসার পর হারিকেনসহ রাতে আলো জ্বালাতে যে জিনিসপত্র ছিল সব ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা মোমবাতি দিয়ে চলি। মোমবাতি দিয়ে কত দিন চলা যায়। এ ছাড়া রাতের অন্ধকারে বন্যপ্রাণীরাও আমাদের বাড়িঘরে হামলা করে।’

কালিগজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সীমা দেববর্মা বলেন, ‘আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা খাবার পানি। এমনিতেই আমরা পাহাড়িরা পানির সমস্যায় ভুগি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকায় মোটর দিয়ে পানি তুলতে পারছি না। স্কুলে এলে কোনো শিক্ষার্থী পানি খেতে পারে না। বিদ্যুৎ না থাকায় শিশুরা লেখাপড়াও করতে পারছে না।’

হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাহুবল আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (ওএন্ডএম) মো. শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘যখন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয় তখন বন বিভাগ বাধা দেয়নি। এমনকি তারা নিজেরাও একটি সংযোগ নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে দুই নম্বর টিলায় সংযোগ দিতে গেলে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে, তাই মামলা করেছে।’ তবে স্বার্থ কী, এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সেটা তিনি জানেন না বলেন।

শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘বন বিভাগ আমাদের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে। মূলত সরকারি দপ্তরের কোনো মামলায় নাম উল্লেখ করার কথা না। এতেই বোঝা যায় তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছে।’

বন বিভাগ বলছে, প্রথম সংযোগের সময়ই বিদ্যুৎ বিভাগকে বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু তারা বাধা উপেক্ষা করে সংযোগ দেয়। এরপর বারবার বলার পরও তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেনি, তাই মামলা করা হয়েছে।

মধুপুর হিল রিজার্ভ ফরেস্ট-এর পুটিজুড়ি বিট কর্মকর্তা রতিন্দ্র কিশোর রায় বলেন, ‘আমার আগে কর্মকর্তা মামলাটি করেছিলেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নিয়ম নেই বলেই মামলাটি করা হয়েছে।’

বাহুবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহুয়া শারমিন ফাতেমা বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নিয়ম নেই এটা সত্য। তবে সংযোগ যেহেতু দেওয়া হয়েছে সুতরাং তিন বছর পর বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা ঠিক হয়নি। আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি। তবে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব না। মানবিক বিষয় বিবেচনা করে পুনরায় সরবরাহের চেষ্টা করব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত