ড. মইনুল ইসলাম
একাত্তর টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. আহসান এইচ মনসুর ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, তাহলে এক ডলারের দাম ১১২-১১৫ টাকায় স্থিতিশীল হবে। আমি তাঁর এই পরামর্শের সঙ্গে অত্যন্ত জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ, হুন্ডি ডলারের ‘প্যারালাল মার্কেটের’ অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে যত দিন এই হুন্ডি ব্যবস্থার চাহিদা কাঠামো চাঙা থাকবে, তত দিন ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে না, কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তেই থাকবে। আন্তব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম যত থাকবে, হুন্ডিওয়ালারা তার চেয়ে ৭-৮ টাকা বেশি দিয়ে ডলার কিনে নেবে পুঁজি পাচারকারীদের কাছে হুন্ডি ডলারের প্রবল চাহিদার কারণে। পুঁজি পাচারকারীদের কাছে ১ ডলারের দাম ১১০ টাকা হলো, নাকি ১২০ টাকা হলো তাতে কিছুই যায়-আসে না, কারণ বেশির ভাগ পাচারকারী যেহেতু তাদের অবৈধ অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যেতেই হুন্ডি ব্যবস্থার সহায়তা নিয়ে থাকে, তাই এ দেশে ডলারের দামকে বাজার ব্যবস্থার কাছে সোপর্দ করে সুফল পাওয়ার পরিবর্তে বিপদকে ডেকে আনা হবে, ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনা যাবে না। হুন্ডিওয়ালারা ‘হুন্ডি ডলারের’ চাহিদাকারীদের প্রয়োজন মোতাবেক প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে আকর্ষণীয় দামে (৭-৮ টাকা বেশি দামে) ডলার সংগ্রহ করেই যাবে। এভাবে লাগামহীনভাবে ডলারের দাম ক্রমাগতভাবে বেড়ে ১ ডলার ১৩০-১৪০-১৫০ টাকায় পৌঁছে গেলে দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া যেভাবে দাবড়ানো শুরু করবে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। দেশের আমদানি ব্যয় এর প্রতিক্রিয়ায় বাড়তেই থাকবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও তাহলে থামানো যাবে না। সাধারণ জনজীবনও এর ফলে অসহনীয় বিপর্যয়ে পতিত হবে। অতএব, আমার মতে সরকারের এখনকার করণীয় হলো হুন্ডি ব্যবস্থার চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য অবিলম্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর দমন-কার্যক্রম বাস্তবায়নে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সময় এ দেশে এখনো আসেনি।
আমার ব্যাখ্যা দেখুন:
ডলার বাজারের বর্তমান লাগামহীন অস্থিরতার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করছে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিদেশে অব্যাহত পুঁজি পাচার। ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। (মানে, সিআইডির দাবি ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই আসছে না। অথচ, এই পরিমাণ টাকা হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে জমা হয়ে যাচ্ছে)। এর সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রতিবছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার লাগামহীন বিস্তারের মাধ্যমে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ শতাংশ কমে ২১.০৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল, যার প্রধান কারণ ওই বছর হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণ আবার চাঙা হওয়া (২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত আট মাসে ফর্মাল চ্যানেলে পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহকে তেমন একটা বাড়ানো যায়নি)।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর চাহিদা এবং সরবরাহ উভয় দিক থেকে হুন্ডি ব্যবসা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল, যার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২৪.৭৪ বিলিয়ন ডলার। এই কারণেই ওই দুই অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। এরপর শুরু হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন। ২০২৩ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী ৩২.৫২ বিলিয়ন ডলার হলেও আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে এসেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পরবর্তী পেমেন্ট দেওয়ার পর সেটা ২৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলারের দাম নির্ধারণে বাজার ব্যবস্থাকে কিছুটা মেনে নিলেও কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত হারের ব্যবধান এখনো ৭-৮ টাকা রয়ে গেছে। এই দুই দামের এত বড় পার্থক্য শুধু হুন্ডি ব্যবস্থাকেই চাঙা করছে, যার ফলে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে বাধ্য। (অর্থমন্ত্রীর মতে, দেশের রেমিট্যান্সের ৪৯ শতাংশ এখন হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশে আসছে। আমার মতে অধিকাংশ রেমিট্যান্স হুন্ডি ব্যবস্থায় দেশে আসছে)! পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে। পুঁজি পাচারের চাহিদার প্রধান গ্রাহক হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণগ্রহীতারা। হুন্ডি প্রক্রিয়ায় যে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার দাবি করছে সিআইডি, তার সিংহভাগ চাহিদাকারী ওপরে উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলো। অতএব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে ‘বাত্ কা বাত্’ বানিয়ে রেখে পুঁজি পাচার সমস্যার সত্যিকার সমাধান পাওয়া অসম্ভব মনে করি।
আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম পুঁজি পাচারের প্রধান প্রধান গন্তব্য কয়েকটি দেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিম পাঠিয়ে পুঁজি পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা, হালহকিকত সংগ্রহ করতে। সরকার রাজি হচ্ছে না কেন বুঝতে পারছি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই এবং ইতালিতে আটটি তদন্ত টিম প্রেরণ কিংবা গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ কি এতই ব্যয়বহুল যে সরকার সেটা এখনো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে নারাজ? শুধু নাম-ঠিকানা সংগ্রহ এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হবে না।
নিচে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো অবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে:
১. এসব পুঁজি পাচারকারীকে বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা এবং পরিচালনা বোর্ড থেকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে
২. এসব পাচারকারীকে ব্যাংকঋণ থেকে অবিলম্বে খারিজ করতে হবে
৩. এদের কাছে যেসব ব্যাংকঋণ খেলাপি ঋণ হিসেবে বছরের পর বছর আটকে আছে, সেগুলো আদায় করার জন্য অবিলম্বে ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে
৪. যেসব চাকরিরত আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার এবং কর্মকর্তার নাম-ঠিকানা পাচারকারী হিসেবে উদ্ঘাটিত হবে, তাঁদের বরখাস্ত করে চাকরি-পরবর্তী সব সুযোগ-সুবিধা বাতিল করতে হবে
৫. যেসব রাজনীতিবিদের নাম পাওয়া যাবে, তাঁরা যদি ক্ষমতাসীন দলের কেউ হন, তাঁদের সব পদ-পদবি থেকে বহিষ্কার করতে হবে
৬. যেসব রপ্তানিকারকের নাম উঠে আসবে, তাঁদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে সেগুলো আদায়ের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। উপরন্তু, তাঁরা তাঁদের রপ্তানি আয় নিয়মিতভাবে দেশে ফেরত আনছেন কি না, সেটা কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে হবে
৭. যেসব আমদানিকারকের নাম পাওয়া যাবে, তাঁরা ওভারইনভয়েসিং করছেন কি না তা কঠোরভাবে পরখ করতে হবে
৮. পুঁজি পাচারকারীর নাম-ঠিকানা সংসদে উত্থাপন করতে হবে এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে।
আমার দ্বিতীয় পরামর্শ হলো, দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হোক, কারণ বেশির ভাগ এক্সচেঞ্জ হাউস হুন্ডি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বলে আমরা খবর পাচ্ছি। আমদানি এলসির ওভারইনভয়েসিং কঠোরভাবে মনিটরিং করার জন্যও আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে তা এখন করা হচ্ছে। রপ্তানি আয় রপ্তানিকারকদের নিজের কাছে রেখে দেওয়ার পরিমাণকে (অনুপাতকে) আগামী কিছুদিনের জন্য কঠোরভাবে সীমিত করা এবং একই সঙ্গে কত দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হবে, সে সময়সীমাকে কঠোরভাবে নামিয়ে আনা সম্পর্কিত আমার পরামর্শকে এখনো বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। গত এক বছরে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান প্রায় ২৪ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় এই অবচয়ন সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে না পারলে ডলারের কার্ব মার্কেটের দামের উল্লম্ফন এবং টাকার বৈদেশিক মানের এই দ্রুত অবচয়নকে থামানো যাবে না। টাকার এই অবচয়ন অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিকে প্রবলভাবে উসকে দিচ্ছে। অতএব এখনকার প্রয়োজন পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ডলারের দামকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া বর্তমান পর্যায়ে মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতির শামিল হবে।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
একাত্তর টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. আহসান এইচ মনসুর ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, তাহলে এক ডলারের দাম ১১২-১১৫ টাকায় স্থিতিশীল হবে। আমি তাঁর এই পরামর্শের সঙ্গে অত্যন্ত জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ, হুন্ডি ডলারের ‘প্যারালাল মার্কেটের’ অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে যত দিন এই হুন্ডি ব্যবস্থার চাহিদা কাঠামো চাঙা থাকবে, তত দিন ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে না, কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তেই থাকবে। আন্তব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম যত থাকবে, হুন্ডিওয়ালারা তার চেয়ে ৭-৮ টাকা বেশি দিয়ে ডলার কিনে নেবে পুঁজি পাচারকারীদের কাছে হুন্ডি ডলারের প্রবল চাহিদার কারণে। পুঁজি পাচারকারীদের কাছে ১ ডলারের দাম ১১০ টাকা হলো, নাকি ১২০ টাকা হলো তাতে কিছুই যায়-আসে না, কারণ বেশির ভাগ পাচারকারী যেহেতু তাদের অবৈধ অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যেতেই হুন্ডি ব্যবস্থার সহায়তা নিয়ে থাকে, তাই এ দেশে ডলারের দামকে বাজার ব্যবস্থার কাছে সোপর্দ করে সুফল পাওয়ার পরিবর্তে বিপদকে ডেকে আনা হবে, ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনা যাবে না। হুন্ডিওয়ালারা ‘হুন্ডি ডলারের’ চাহিদাকারীদের প্রয়োজন মোতাবেক প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে আকর্ষণীয় দামে (৭-৮ টাকা বেশি দামে) ডলার সংগ্রহ করেই যাবে। এভাবে লাগামহীনভাবে ডলারের দাম ক্রমাগতভাবে বেড়ে ১ ডলার ১৩০-১৪০-১৫০ টাকায় পৌঁছে গেলে দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া যেভাবে দাবড়ানো শুরু করবে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। দেশের আমদানি ব্যয় এর প্রতিক্রিয়ায় বাড়তেই থাকবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও তাহলে থামানো যাবে না। সাধারণ জনজীবনও এর ফলে অসহনীয় বিপর্যয়ে পতিত হবে। অতএব, আমার মতে সরকারের এখনকার করণীয় হলো হুন্ডি ব্যবস্থার চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য অবিলম্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর দমন-কার্যক্রম বাস্তবায়নে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সময় এ দেশে এখনো আসেনি।
আমার ব্যাখ্যা দেখুন:
ডলার বাজারের বর্তমান লাগামহীন অস্থিরতার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করছে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিদেশে অব্যাহত পুঁজি পাচার। ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। (মানে, সিআইডির দাবি ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই আসছে না। অথচ, এই পরিমাণ টাকা হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে জমা হয়ে যাচ্ছে)। এর সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রতিবছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার লাগামহীন বিস্তারের মাধ্যমে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ শতাংশ কমে ২১.০৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল, যার প্রধান কারণ ওই বছর হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণ আবার চাঙা হওয়া (২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত আট মাসে ফর্মাল চ্যানেলে পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহকে তেমন একটা বাড়ানো যায়নি)।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর চাহিদা এবং সরবরাহ উভয় দিক থেকে হুন্ডি ব্যবসা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল, যার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২৪.৭৪ বিলিয়ন ডলার। এই কারণেই ওই দুই অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। এরপর শুরু হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন। ২০২৩ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী ৩২.৫২ বিলিয়ন ডলার হলেও আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে এসেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পরবর্তী পেমেন্ট দেওয়ার পর সেটা ২৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলারের দাম নির্ধারণে বাজার ব্যবস্থাকে কিছুটা মেনে নিলেও কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত হারের ব্যবধান এখনো ৭-৮ টাকা রয়ে গেছে। এই দুই দামের এত বড় পার্থক্য শুধু হুন্ডি ব্যবস্থাকেই চাঙা করছে, যার ফলে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে বাধ্য। (অর্থমন্ত্রীর মতে, দেশের রেমিট্যান্সের ৪৯ শতাংশ এখন হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশে আসছে। আমার মতে অধিকাংশ রেমিট্যান্স হুন্ডি ব্যবস্থায় দেশে আসছে)! পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে। পুঁজি পাচারের চাহিদার প্রধান গ্রাহক হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণগ্রহীতারা। হুন্ডি প্রক্রিয়ায় যে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার দাবি করছে সিআইডি, তার সিংহভাগ চাহিদাকারী ওপরে উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলো। অতএব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে ‘বাত্ কা বাত্’ বানিয়ে রেখে পুঁজি পাচার সমস্যার সত্যিকার সমাধান পাওয়া অসম্ভব মনে করি।
আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম পুঁজি পাচারের প্রধান প্রধান গন্তব্য কয়েকটি দেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিম পাঠিয়ে পুঁজি পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা, হালহকিকত সংগ্রহ করতে। সরকার রাজি হচ্ছে না কেন বুঝতে পারছি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই এবং ইতালিতে আটটি তদন্ত টিম প্রেরণ কিংবা গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ কি এতই ব্যয়বহুল যে সরকার সেটা এখনো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে নারাজ? শুধু নাম-ঠিকানা সংগ্রহ এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হবে না।
নিচে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো অবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে:
১. এসব পুঁজি পাচারকারীকে বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা এবং পরিচালনা বোর্ড থেকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে
২. এসব পাচারকারীকে ব্যাংকঋণ থেকে অবিলম্বে খারিজ করতে হবে
৩. এদের কাছে যেসব ব্যাংকঋণ খেলাপি ঋণ হিসেবে বছরের পর বছর আটকে আছে, সেগুলো আদায় করার জন্য অবিলম্বে ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে
৪. যেসব চাকরিরত আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার এবং কর্মকর্তার নাম-ঠিকানা পাচারকারী হিসেবে উদ্ঘাটিত হবে, তাঁদের বরখাস্ত করে চাকরি-পরবর্তী সব সুযোগ-সুবিধা বাতিল করতে হবে
৫. যেসব রাজনীতিবিদের নাম পাওয়া যাবে, তাঁরা যদি ক্ষমতাসীন দলের কেউ হন, তাঁদের সব পদ-পদবি থেকে বহিষ্কার করতে হবে
৬. যেসব রপ্তানিকারকের নাম উঠে আসবে, তাঁদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে সেগুলো আদায়ের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। উপরন্তু, তাঁরা তাঁদের রপ্তানি আয় নিয়মিতভাবে দেশে ফেরত আনছেন কি না, সেটা কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে হবে
৭. যেসব আমদানিকারকের নাম পাওয়া যাবে, তাঁরা ওভারইনভয়েসিং করছেন কি না তা কঠোরভাবে পরখ করতে হবে
৮. পুঁজি পাচারকারীর নাম-ঠিকানা সংসদে উত্থাপন করতে হবে এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে।
আমার দ্বিতীয় পরামর্শ হলো, দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হোক, কারণ বেশির ভাগ এক্সচেঞ্জ হাউস হুন্ডি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বলে আমরা খবর পাচ্ছি। আমদানি এলসির ওভারইনভয়েসিং কঠোরভাবে মনিটরিং করার জন্যও আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে তা এখন করা হচ্ছে। রপ্তানি আয় রপ্তানিকারকদের নিজের কাছে রেখে দেওয়ার পরিমাণকে (অনুপাতকে) আগামী কিছুদিনের জন্য কঠোরভাবে সীমিত করা এবং একই সঙ্গে কত দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হবে, সে সময়সীমাকে কঠোরভাবে নামিয়ে আনা সম্পর্কিত আমার পরামর্শকে এখনো বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। গত এক বছরে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান প্রায় ২৪ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় এই অবচয়ন সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে না পারলে ডলারের কার্ব মার্কেটের দামের উল্লম্ফন এবং টাকার বৈদেশিক মানের এই দ্রুত অবচয়নকে থামানো যাবে না। টাকার এই অবচয়ন অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিকে প্রবলভাবে উসকে দিচ্ছে। অতএব এখনকার প্রয়োজন পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ডলারের দামকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া বর্তমান পর্যায়ে মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতির শামিল হবে।
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
২ দিন আগেবিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪