Ajker Patrika

আধুনিক প্রযুক্তিতে গুণগত মানের মাছ উৎপাদন

শাইখ সিরাজ
আধুনিক প্রযুক্তিতে গুণগত মানের মাছ উৎপাদন

সময়টা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যুগের। প্রযুক্তির উৎকর্ষে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই শতাব্দীতে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় হয়ে উঠেছে কৃষিশিল্প। ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত প্রযুক্তির পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে এবং অল্প খরচে বেশি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে সবাই; যা বছর পাঁচেক আগেও কল্পনা করা যেত না।

এমন প্রযুক্তির বাস্তবিক প্রয়োগ বিস্ময়করভাবে সফলতার বার্তা দিচ্ছে। ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়েও এক তরুণ উদ্যোক্তা সেই সাফল্যের খোঁজেই নিজেকে যুক্ত করেছেন মাছ চাষে। আর একেকটি পুকুর থেকে তুলে আনছেন রুপালি ফসল। প্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের শোনাতে চাই তাঁরই গল্প। তবে এর আগে দু-একটি বিষয়ে আলোকপাত করে নিতে চাই।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি হিসাব মতে, পৃথিবীতে কৃষিকাজ হয় মোট আয়তনের ৩৮ শতাংশে। আগে এ অংশটি ছিল অনেক কম। দিনে দিনে আবাদি এলাকার আয়তন বাড়ছে। কিন্তু বনভূমি, আবাসন, অবকাঠামো, জলায়তন—সব বিবেচনায় আবাদি এলাকা খুব বেশি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তাই পুরো পৃথিবীই এখন নড়েচড়ে বসেছে অল্প জায়গায় বেশি উৎপাদনের জন্য।

একই সঙ্গে মাটি, পানিসহ প্রকৃতির সব অপরিহার্য উপাদান কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কীভাবে উৎপাদনের গতি বৃদ্ধি করা যায়, এ ব্যাপারেও উদ্যোগী বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা। কৃষির মতো মৎস্য উৎপাদন খাতেও এই প্রবণতা শুরু হয়েছে জোরেশোরে। আমাদের দেশে মাছ চাষে এক বিপ্লব ঘটে গেছে। হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

আমি আশির দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নিবিড়ভাবে দেশের মাছ চাষ সম্প্রসারণের চিত্রটি কাছ থেকে দেখছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘হাকিম আলীর মৎস্য খামার’ দেখে অনুপ্রাণিত হাজারো তরুণ মাছ চাষে উদ্যোগী হওয়ায় এখন মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম। চাষের মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ও ভিয়েতনাম পাশাপাশি অবস্থান করছে।

এ দুই দেশের জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রতিবেশ প্রায় কাছাকাছি ধরনের। মাছের উৎপাদনে কাছাকাছি হলেও রপ্তানিতে ভিয়েতনাম থেকে আমরা পিছিয়ে আছি অনেকখানি। ২০১৯ সালে ভিয়েতনাম শুধু পাঙাশ রপ্তানি করে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে।

তাদের রপ্তানি করা মাছের পরিমাণ ছিল আড়াই লাখ টন। ভিয়েতনামে ব্যাপক হারে পাঙাশের চাষ হয়। কারণ তাদের উৎপাদিত মাছ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। তারা তাদের উৎপাদিত মাছের মান ঠিক রাখছে। ফলে তাদের মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

ভিয়েতনামের পাঙাশে গন্ধ নেই এবং গায়ের রংও সাদা। অন্যদিকে আমাদের দেশে উৎপাদিত পাঙাশের রং হলদেটে ও গন্ধময়। ফলে দেশের বাজারেই কদরহীন হয়ে পড়ছে পাঙাশ। আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বেশি চাহিদা রয়েছে তেলাপিয়ার। বাংলাদেশ তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। প্রতিবছর উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও এ দুই মাছে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ।

গবেষকেরা গবেষণা করে এর কারণও নির্ণয় করেছেন। তাঁদের মতে, আমাদের দেশে মাছের জন্য যে খাবার তৈরি করা হচ্ছে, এর উপাদানে ভুট্টার ব্যবহার বেশি। এই ভুট্টার কারণে পাঙাশ মাছের গায়ের রং হলদেটে হচ্ছে। যদি খাবারে ভুট্টার বদলে সয়াবিনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে এই সমস্যা আর থাকবে না। আমাদের পুকুরের পানি ব্যবস্থাপনাতেও সমস্যা রয়েছে। যেসব বড় ফার্ম রয়েছে, সেগুলোর পানির সমস্যা কম। তবে মাঝারি ও ছোট ফার্মগুলোয় পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের সমস্যা আছে এবং অ্যামোনিয়ার পরিমাণও বেশি। তাই পুকুর ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে।

বলছিলাম, এক তরুণের কথা। যিনি ইংল্যান্ড থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়েও দেশে ফিরে শুরু করেছেন মাছের চাষ। তিনি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে মাছের চাষ করছেন। এই তরুণের নাম শাহাদাত বিন জামান শোভন। তিনি সাতটি পুকুরে পুরোদমে মাছ চাষ করছেন। পাঠক, যাঁরা আমার হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক, তাঁরা হয়তো রি-সার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার, অর্থাৎ আরএএস ও বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ঘরের ভেতর, বাড়ির আঙিনায় অধিক ঘনত্বের মাছ চাষের বিষয়টি ইতিমধ্যে মোটামুটি জেনে গেছেন। জেনেছেন বটমক্লিন রেসওয়ে এবং ইনপন্ড রেসওয়ে সিস্টেম বা আইপিআরএস সম্পর্কেও। একাধিক প্রতিবেদনে এসব পদ্ধতি আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। শোভন মাছ চাষের জন্য বেছে নিয়েছেন বটমক্লিন রেসওয়ে সিস্টেম।

আমাদের মৎস্যশিল্পে বিগত সময়ে যেসব প্রধান সমস্যা মৎস্যচাষিদের কাছ থেকে বারবার উঠে এসেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম অ্যামোনিয়া বা মাছের বর্জ্য। মাছের বর্জ্য ও খাদ্যের অবশিষ্টাংশ পুকুরের পানিতে মিশে পানি এবং মাটি দূষিত হয়ে যায়। পানিতে অক্সিজেনের অভাব হয়। ফলে কয়েক বছরের মাথায় মাছের উৎপাদন কমে যায়। যদি পানি থেকে অ্যামোনিয়া বর্জ্য সরিয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে অধিক ঘনত্বেও মাছ চাষ করা সম্ভব। রেসওয়ে বটমক্লিন পদ্ধতি হচ্ছে, পানিতে প্রবাহ তৈরি করে জলাশয়ের বর্জ্য তলানিতে নিয়ে গিয়ে অপসারণ করা।

পুকুরের পানিতে অ্যারেটরের মাধ্যমে রেসওয়ের মতো গোল আবর্ত তৈরি করা হয়। আবর্তে পড়ে বর্জ্যগুলো জমা হয় তলানিতে। এই পদ্ধতিতে পুকুরের তলানিতে বিশেষ স্থান রাখা হয়, এটাকে বলা যায় মাছের টয়লেট। সেখানে যুক্ত করা হয় পাম্প। পাম্পের দ্বারা তলানিতে জমা বর্জ্য প্রতিনিয়ত অপসারণ করে পানি রাখা হয় দূষণমুক্ত। পাশাপাশি প্রচুর অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়। অ্যারেটর পানিতে প্রবাহের সৃষ্টি করে। এতে মাছও সুস্থ জীবনের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে। অ্যারেটর তৈরি স্রোত ও প্রবাহের কারণে মাছের রং ও স্বাদ হয় নদীর মাছের মতোই।

শোভন ঘুরিয়ে দেখালেন তাঁর মাছের খামার। সাতটি পুকুরের পাঁচটিতে চলছে পলিপন্ড বটমক্লিন রেসওয়ে সিস্টেমে মাছ চাষ। আর বাকি দুটিতে প্রচলিত পদ্ধতির মাছ চাষ। তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষ কতটা উৎপাদন বাড়াতে পারে। এমনিতে সাধারণভাবে মাছ চাষের জন্য একটি পুকুরে ১০ হাজার পোনা ছাড়া যায়। কিন্তু সেই একই পুকুরে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১ লাখ পোনা ছেড়েছেন শোভন এবং তার ফলাফলও বেশ আশা জাগিয়েছে তাঁর মধ্যে।

প্রযুক্তির ব্যবহারে এই চাষ-প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ বেশি হলেও তিনি বলেছেন বাজার ও চাহিদা বুঝে চাষ করলে আড়াই থেকে তিন বছরেই খরচ তুলে আনা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, প্রযুক্তি ব্যবহারে মাছের গুণগত মান ভালো থাকায় গুড অ্যাকুয়াকালচার প্র্যাকটিসের আওতায় এই মাছ বাইরের দেশে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। সেই পথেই হাঁটবেন শোভন। চাষের মাছ নিয়ে বিশ্ববাজারে পৌঁছাতে চান তিনি।

মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন নেতৃত্বের ভূমিকায়। দেশে এখন প্রায় চার কোটি মানুষ মৎস্য খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত। মাছ চাষের জোয়ারে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে আধুনিক সব কৌশল। তরুণ, শিক্ষিত যুবক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও শুরু করেছে প্রযুক্তির সহায়তায় আধুনিক মাছ চাষ।

রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম (আরএএস), বায়োফ্লক, বটমক্লিন কিংবা ইনপন্ড রেসওয়ে সিস্টেমসহ নানা প্রযুক্তির ব্যবহারে যেমন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, তেমনি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা জাতের মাছ চাষের আওতায় আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

আশির দশক থেকে বর্তমান সময়ে এসে মাছ উৎপাদনে যে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে, এর পেছনে রয়েছে শোভনের মতো অসংখ্য উদ্যোক্তার সাহসী উদ্যোগ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাছ চাষে যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। সুপার ইনটেনসিভ বা বেশি ঘনত্বের মাছ চাষ নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি গবেষণা চলছে মাছের জাত-বৈচিত্র্য নিয়েও।

তরুণদের হাতে সম্প্রসারিত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদ। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও তদারকির। এসব উদ্যোগ কতটা বিজ্ঞানসম্মত ও পরিবেশবান্ধব, তারও যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে মাছ চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশে এর আরও বড় সাফল্য রচিত হবে।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রশিক্ষণ ছাড়াই মাঠে ৪২৬ সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা

গ্রাহকের ২,৬৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৪৬ বিমা কোম্পানি

১০০ বছর পর জানা গেল ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রত্যঙ্গটি নারীর প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

‘এই টাকা দিয়ে কী হয়, আমি এত চাপ নিচ্ছি, লাখ পাঁচেক দিতে বলো’, ওসির অডিও ফাঁস

কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত