Ajker Patrika

উচ্চাঙ্গসংগীত

শহিদুল ইসলাম
Thumbnail image

উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের নানা জায়গার লোকসংগীতের ধারাটি খুবই শক্তিশালী, অনিন্দ্যসুন্দর ও জনপ্রিয়। তিনি বাংলার লোকসংগীতেরও প্রশংসা করেন। কিন্তু তিনি পাঞ্জাব, সিন্ধু ও মুলতানের লোকসংগীতের কথাই বেশি বললেন। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, তিনি ওই এলাকার মানুষ।

সেই সাক্ষাৎকারে তাঁর মূল কথাটি ছিল লোকসংগীত উচ্চাঙ্গসংগীতের আসল শেকড়। তিনি ডেমোনেস্ট্রেশনের মাধ্যমে চমৎকার করে বুঝিয়ে বলেন, যেন একটি শিশুকে সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছেন। আদিতে ধ্রুপদ ধামারের মাধ্যমেই সেই লোকসংগীতের সুরটি শ্রোতার কানে পৌঁছাত। তারপর একটু তরল খেয়াল জায়গা করে নেয়। খান সাহেবের প্রপিতামহ প্রথম ঠুংরির প্রচলন করেন। টোড়ি রাগে খেয়াল কীভাবে একই রাগের ঠুমরিতে পরিণত হয়, তা সুন্দরভাবে গেয়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি সেই সাক্ষাৎকারে।

প্রায় ২০০ বছরের কাসুর ঘরানার উস্তাদরা স্থানীয় রাজা-মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এভাবেই ওই অঞ্চলের উচ্চাঙ্গসংগীতের ধারাকে বহন করেছেন।

উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান ১৯০২ সালে ভারতের পাঞ্জাবের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই বসবাস করে সংগীত সাধনা করেন। লাহোরে উচ্চাঙ্গসংগীতের ধারাটি খুব শক্তিশালী। এখানে অনেক উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পীর জন্ম হয়েছে। যেমন নাজাকাত-সালামত আলী, আমানত-ফতে আলী খান, গজলসম্রাট মেহেদী হাসান, ফরিদা খানম, নূরজাহান বেগম প্রমুখ।

এমন অনেক মহারথী উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পীর কথা বলা যায়। সংগীতসম্রাট আল্লাদিয়া খানের জন্ম রাজস্থানের উনিয়ারায়। তিনি জয়পুর-আত্রাউলি ঘরানার স্রষ্টা। তিনি অনেক রাগ-রাগিণীর স্রষ্টাও। রাজস্থানের লোকগীতি ‘হাভেলি’ তাঁর প্রেরণার উৎস। তাঁর ছোট ভাই উস্তাদ হায়দার খান, পুত্র উস্তাদ মনজি খান ও উস্তাদ ভুরজি খান ছাড়াও সাগরেদের মধ্যে আছেন—সারেঙ্গিবাদক উস্তাদ আব্দুল মজিদ খান, পণ্ডিত ভাস্করবুয়া বাখালে, পণ্ডিত ওয়ামানরাও সাদলিকর; পরবর্তী প্রজন্মের পণ্ডিত মল্লিকার্জুন মনসুর, বিদুষী মগুবাই কুর্দিকর, বিদুষী শ্রুতি সাদলিকর প্রমুখ। একসময় তিনি মুম্বাইয়ে চলে যান। সেখানে একঝাঁক উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী তাঁকে ‘সংগীতসম্রাট’ বলে স্বীকার করে নেন। প্রতিবছর মুম্বাইয়ে তাঁর নামে সর্বভারতীয় সংগীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৫ সালে তাঁর ১৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী ভারতজুড়ে পালিত হয়।

একসময় পাকিস্তানেও সংগীতের এ ধারাটি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু ইসলামি জাতীয়তাবাদী পাকিস্তানের সৃষ্টি সংগীতের এই শক্তিশালী ধারাকে দুর্বল করে দেয়। এরপরও উচ্চাঙ্গসংগীতের সে ধারাটি একেবারেই শুকিয়ে যায়নি। কয়েক বছর থেকে দেখছি, পাকিস্তানের হারানো উচ্চাঙ্গসংগীতের ধারাটি ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে।

তারা প্রথমে ভারতের ৩০ থেকে ৪০ বছরের কয়েকজন উচ্চাঙ্গসংগীত গাইয়েকে নিয়ে পাকিস্তান টেলিভিশনের সহায়তায় ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। উপস্থিত শ্রোতারা হলেন বৃদ্ধ ও মাঝ বয়সী ভদ্রলোক। এমন চারজনের দুই-তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান শুনেছি। তাঁদের মধ্যে কলকাতার বাঙালি মেয়ে সুচিস্মিতা দাসের নামটি মনে আছে।

বয়স প্রায় ৩০। একজন ছিলেন জয়পুরের নারী, যাঁর স্বামী বাঙালি। আট বছরের একটি মেয়েও ছিল। উপস্থাপক স্মার্ট মেয়েটি বলল, পাকিস্তানে এখন এই বয়সের মেয়েরা সচরাচর গান গায় না। জয়পুরের নারী শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলেন, সংসার ও চাকরি করার পর গান করেন কী করে? তিনি স্বামী ও মেয়ের সহযোগিতার কথা বললেন। আরও জানালেন, তিনি কত্থক নাচও করেন। এখন দেখা যায়, দুই-চারজন পাকিস্তানি ছেলেমেয়েরাও গাইছেন।

ভারত থেকে এক নারী গজল গাইতে গিয়েছিলেন সেখানে। তিনি জানালেন, মেহেদী হাসান তাঁর আইডল। তিনি একই সঙ্গে নূরজাহান ও লতা মঙ্গেশকরের গান গাইলেন। এটুকু বললাম এটা বোঝার জন্য যে, পাকিস্তান আবার ধ্রুপদি সংগীতে ঘুরে দাঁড়াতে চায়।

কলকাতার বাঙালি উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী অনেকের কাছেই তালিম নেন। তবে প্রধানত উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান ও উস্তাদ মুনওয়ার আলী খানের কাছেই সর্বাধিক সময় তালিম নেন। তাই তিনি পাতিয়ালা ঘরানার বর্তমান সময়ের একজন প্রতিনিধি।

তাঁর মেয়ে কৌশিকী চক্রবর্তী বাবাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ পারিবারিকভাবে তাঁরা সংগীতের চর্চা করেন। জন্মের পর থেকেই তাঁর সংগীত শিক্ষা শুরু। তাই আজ তিনি তাঁর প্রজন্মের অন্যতম প্রধান গায়িকা। দেশ-বিদেশ থেকে তিনি আমন্ত্রণ পান।

কিন্তু অজয় চক্রবর্তীর কলকাতার শ্রুতিনন্দনে প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী উচ্চাঙ্গসংগীতের ক্লাস করে। তাদের মধ্যে কজন কৌশিকীর মতো হবেন? দেশ-বিদেশে গাইবার জন্য একটি বিশেষ স্তরে উঠতেই হবে। কিন্তু বর্তমান অর্থনীতিতে জীবন সংসার চালিয়ে একজন কি সংগীতকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারেন? যেটা কৌশিকীর পক্ষে সম্ভব হয়েছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

বিয়ে করলেন সারজিস আলম

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়ছে শ্রীলঙ্কা, ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ কোথায় দেখবেন

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাইভেট কারে ধাক্কা, জাবিতে ১২ বাস আটকে ক্ষতিপূরণ আদায় ছাত্রদলের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত