Ajker Patrika

প্রবীণের ক্যানসার ঝুঁকি ও করণীয়

হাসান আলী
প্রবীণের ক্যানসার ঝুঁকি ও করণীয়

ক্যানসার সব বয়সে হতে পারে, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। আবার পুরুষের চেয়ে নারীদের ঝুঁকি বেশি।পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হলো ক্যানসার। সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি লোক ক্যানসারে মারা যায়।চিকিৎসায় শিশুর ক্যানসার নিরাময় প্রায় শতভাগ, যদি প্রাথমিক স্তরে রোগ নির্ণয় করা যায়। বাংলাদেশ শিশুর ক্যানসার চিকিৎসায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রবীণদের যদি প্রাথমিক স্তরে ক্যানসার শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তবে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ক্যানসারের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়কে প্রাথমিক স্তর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তৃতীয় পর্যায় হলো লোকালি অ্যাডভান্স স্টেজ। চতুর্থ পর্যায় হলো, অ্যাডভান্স স্টেজ।

প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ শরীরের যে অঙ্গে সৃষ্টি হয়, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। অপারেশন, রেডিয়েশন এবং ওষুধ সেবনের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ স্টেজে রোগীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রোগীকে সুস্থ করা যায়, কিন্তু ক্যানসার পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না। শুধু আয়ু বাড়ানো যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা প্রায় ৮৪ রকমের ক্যানসারের সন্ধান পেয়েছেন। আমরা স্তন, জরায়ু, প্রোস্টেট, লিভার, কোলন, ফুসফুস, রক্ত, কিডনি, থাইরয়েড ও মুখের ক্যানসারের কথা বেশি শুনতে পাই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বর্তমান বিশ্বে ক্যানসার যেভাবে থাবা প্রসারিত করেছে, তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি ১০ জনে ১ জনের ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ক্যানসারের কারণ বার্ধক্য, স্থূলতা, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন সম্পর্ক, মানব প্যাপিলোমা ভাইরাস, ধূমপান, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় গ্রহণ, বায়ুদূষণ, রেডিয়েশন, ভাজাপোড়া ও আগুনে ঝলসানো খাবার গ্রহণ, বংশের কারও ক্যানসার থাকলে।

ক্যানসারের লক্ষণগুলো হলো পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, বমি ভাব বা প্রচণ্ড বমি, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, অবসাদ, শরীর টালমাটাল, অসহনীয় মাথাব্যথা, দীর্ঘদিন ধরে খাবারে অরুচি, ত্বকের পরিবর্তন, ঘন ঘন জ্বর, মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন, শরীরের কোনো স্থানে চাকা থাকা।

ওপরের লক্ষণগুলো কারও মধ্যে দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ বা মতামত নিতে হবে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক নিশ্চিত হন ক্যানসার হয়েছে কি না। মেমোগ্রাম ও কোলোনস্কপি করে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা যাচাই করা যায়।সুস্থ জীবনচর্চা এবং নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক্যানসার প্রতিরোধে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে।

ক্যানসার প্রতিরোধে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ।খাবারে কম লবণ এবং ভাজাপোড়া, ঝলসানো খাবার পরিহার করতে হবে। শরীরের কাঙ্ক্ষিত ওজন বজায় রাখা। নিরাপদ যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ থাকা। ধূমপান না করা এবং ধূমপানের স্থান পরিহার করা। সপ্তাহের অধিকাংশ দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হালকা বা মাঝারি ব্যায়াম করা। অ্যালকোহলজাতীয় পানীয় পান থেকে বিরত থাকা কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শে পান করা। জীবনকে কর্মচঞ্চল করে তুলতে হবে। দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। কর্মস্থলে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদানের বিষয়ে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার নির্দেশনা অনুসরণ করা।

সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার পরও ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ক্যানসার ব্যক্তির যেমন শারীরিক বিপর্যয় ঘটায়, তেমনি একই সঙ্গে মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটায়। আমাদের দেশের প্রবীণদের অধিকাংশই গরিব। তাঁদের জন্য ক্যানসার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হয় না। সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে গরিব রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসাসেবা-ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় গরিব রোগীদের দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি অচল থাকলে কিংবা না থাকলেও রোগীর খরচ এবং বিড়ম্বনা বাড়ে।

প্রবীণ বয়সে মানুষের শরীরে নানা ধরনের রোগের বসবাস শুরু হয়। শরীরের কর্মক্ষমতা কমে যায়। অনেকেই একাকী বসবাস করেন। সেবাযত্ন করার মতো কাউকে পাওয়া যায় না।

সামর্থ্যবান প্রবীণেরা সেবা কিনতে পারলেও গরিবেরা পারেন না। যক্ষ্মার মতো ক্যানসার চিকিৎসাও সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে হলে দালাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতালের যন্ত্রণা লাঘব হতো। ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসায় সহায়-সম্বল বিক্রি করে পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায় আবার রোগীকেও বাঁচাতে পারে না।

প্রবীণ যখন বুঝতে পারেন তাঁর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা কম বা নেই, তখন তাঁর মধ্যে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগে। রোগীর যন্ত্রণা লাঘবে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা মৃত্যুযন্ত্রণা প্রশমন কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়। গরিব রোগীদের জন্য বিনা মূল্যে প্যালিয়েটিভ কেয়ার পাওয়ার সুযোগ রাখা জরুরি। ব্যক্তিগত বা সামাজিক উদ্যোগে প্যালিয়েটিভ কেয়ার স্থাপন করা গেলে মৃত্যুপথযাত্রী প্রবীণদের কষ্ট অনেকখানি লাঘব হবে।

স্থানীয় পর্যায়ে সামর্থ্যবান মানুষদের উদ্যোগে ক্যানসার চিকিৎসা তহবিল গঠন করা গেলে চিকিৎসারত অসহায় প্রবীণদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হতো। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা প্রবীণেরা ক্যানসার আক্রান্ত হলে তাঁদের চিকিৎসায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এগিয়ে আসেন। যেসব প্রবীণ যৌবনে কৃষিতে, কলকারখানায়, সেবা খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রেখেছেন, তাঁদের চিকিৎসায় তেমন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। ক্যানসারের যন্ত্রণা ধনী-গরিব সবার জন্য একই রকম। রোগ নিরাময়, রোগ প্রতিরোধ, যন্ত্রণা উপশম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত কষ্ট লাঘবে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

লেখক: সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত