Ajker Patrika

জনতার শক্তিতে সাহসের সেতু

রাশেদ নিজাম, তানিম আহমেদ ও নাজমুল হাসান সাগর
আপডেট : ২৬ জুন ২০২২, ১৩: ১২
জনতার শক্তিতে সাহসের সেতু

চারপাশে কড়া পাহারা। কিন্তু আবেগের ঢেউয়ে বাদ সাধতে পারেনি কেউ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে উদ্বোধনের পর যখন পদ্মা সেতু পেরিয়ে জাজিরা প্রান্তে গেলেন, তখন হাজারো মানুষের স্রোত সেতুমুখী। দীর্ঘদিন ধরে লালিত স্বপ্ন, মনের গহিনে জমে থাকা ভালোবাসাকে একনজর ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা।

আমার পদ্মা সেতু, আমাদের পদ্মা সেতু। এককথায় বলতে ‘সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার’। খুলে গেছে দখিনা দুয়ার, সড়কপথে মিলেছে পুরো বাংলাদেশ। আর ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ঝড়-বৃষ্টিতে অপূর্ণ থাকবে না স্বজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার সাধ। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘বর্ষাকালে এই পদ্মা নদী খরস্রোতা। নদী পার হতে যেয়ে আর কাউকে সন্তান হারাতে হবে না, বাবা-মাকে হারাতে হবে না, ভাইবোনকে হারাতে হবে না। আজকে আপনারা নির্বিঘ্নে চলতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। আর যারা বাধা দিয়েছিল, তাদের একটা জবাব আমরা দিয়েছি। তাদের উপযুক্ত একটা জবাব—এই পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে আমরা দিতে পারলাম—বাংলাদেশ পারে।’

উদ্বোধন হবে বাংলাদেশের স্বপ্নের সেতুর। গতকাল ভোর থেকেই সেতুর দুই পারের জনপদে ছিল আনন্দের বন্যা। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী, এমপি, দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, কূটনীতিকেরা মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে অংশ নেওয়ায় নিরাপত্তা ছিল কঠোর। তবে কিছুটা শিথিল চিত্র ছিল ওপারে জাজিরায়। যেহেতু এপারে উদ্বোধনের পরে শেখ হাসিনা জনসভায় যোগ দেবেন, তাই দুপুর পর্যন্ত বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছিল মাদারীপুর, শরীয়তপুরে।

মাওয়ায় সকাল ১০টায় শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর শুরুর সম্ভাব্যতা যাচাই ও নির্মাণকাজ নিয়ে তাঁর ও আওয়ামী লীগ সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীর প্ররোচনায় ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য অংশীদারেরা এ প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। সে সময়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, কিছু গণমাধ্যম ও অর্থনীতিবিদদের করা সমালোচনার প্রসঙ্গেও কথাও বলেন সরকারপ্রধান।

কানাডার আদালত যখন পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি বলে রায় দিলেন, তখন সবাই চুপ হয়ে গেলেন। কারও মুখে কোনো কথা ছিল না বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘তাঁদের কারণে আমাদের কয়েকজন সহকর্মী যে মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেন, তা নিয়ে সামান্য দুঃখ পর্যন্ত প্রকাশ করলেন না। কিন্তু আমি জানতাম, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির কোনো ষড়যন্ত্র হয়নি। আর এ কারণেই এই সেতু নির্মাণে আমার জেদ চাপে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বের কাছে আমরা প্রমাণ করেছি, আমরাও পারি। পদ্মা সেতু তাই আত্মমর্যাদা ও বাঙালির সক্ষমতা প্রমাণের সেতু শুধু নয়, পুরো জাতিকে অপমান করার প্রতিশোধও। বাংলাদেশের জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা। আমি তাঁদের স্যালুট জানাই।’

যারা পদ্মা সেতু নির্মাণে বিরোধিতা করেছে, সমালোচনা ও ষড়যন্ত্র করেছে, তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যড়যন্ত্রকারীদের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়। আশা করছি, তাদের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার পঙ্‌ক্তি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাঙালি জাতি কখনো মাথা নোয়ায় না।’

সুধী সমাবেশের শেষে পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধন খাম, সিলমোহর ও ১০০ টাকার স্মারক নোট উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।

দুপুর ১২টার দিকে টোল দিয়ে পদ্মা সেতুতে যাত্রা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। মোনাজাতের পর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করেন। স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম পার হওয়া মাওয়া থেকে জাজিরাগামী এই গাড়িবহরই নাম লেখায় ইতিহাসে। জাতির জনকের কন্যার এই যাত্রার মধ্য দিয়েই পদ্মার বিচ্ছিন্ন দুই পার এক হলো। জাজিরা যাওয়ার পথে সেতুর মাঝপথে থামে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর। পরে যোগ দেন মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফেরিঘাটে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায়। তার আগে জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন ও মোনাজাতে অংশ নেন।

জনসভায় জনগণের শক্তিই বড় শক্তি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের পাশে থাকার সাহসের কারণে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখায় মানুষ ভোট দিয়ে বারবার আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করে। ২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সরকার পদ্মা সেতুর নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও খালেদা জিয়ার সরকার এর কাজ বন্ধ করে দেয় বলে জানান তিনি।

আওয়ামী লীগ কখনোই পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারবে না—বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞাসা করি—আসুন, দেখে যান পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কি না? আমাদের অনেক জ্ঞানী-গুণী লোক ছিল, অর্থনীতিবিদ, বড় বড় আমলা—সবাই বলেছেন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু সম্ভব নয়। আজকে নিজেদের টাকায় কীভাবে করতে পারলাম?’

গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক এমডি ড. ইউনূস বিশ্বব্যাংকে তদবির করে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছিলেন অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বলল দুর্নীতি হয়েছে। কে দুর্নীতি করেছে? যে সেতু আমাদের প্রাণের সেতু। যে সেতুর সঙ্গে আমার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য জড়িত, সেই সেতু করতে গিয়ে কেন দুর্নীতি হবে? তারা (বিশ্বব্যাংক) টাকা দেয়নি। অথচ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র বলে টাকা বন্ধ করে দিল।’

সিলেটের বন্যার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বন্যার সঙ্গে আমাদের বসবাস। সিলেটে বন্যা হয়েছে। আমরা সেখানে ত্রাণ পাঠিয়েছি। এখন বর্ষাকাল। আমাদের এই অঞ্চলে বন্যা হতে পারে। এখন থেকে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপনারাও প্রস্তুতি নেবেন। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার শক্তি বাংলাদেশ রাখে। বাংলাদেশের জনগণ রাখে। সেই ব্যবস্থাও আপনাদের নিতে হবে।’

পদ্মা সেতু তৈরি করতে গিয়ে যাঁরা জমি দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে বসবাসের জমি ও ঘর করে দেওয়ার পাশাপাশি জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলেও জানান সরকারপ্রধান। দেশবাসীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমি যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত। আপনাদের জন্য প্রয়োজনে আমার নিজের জীবনটা দেব। সবার কাছে দোয়া চাই যেন পিতার স্বপ্ন পূরণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত