Ajker Patrika

মাঝনদীতে জুয়ার ফাঁদে নিঃস্ব যাত্রীরা

শিবালয় (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১: ৩৪
মাঝনদীতে জুয়ার ফাঁদে নিঃস্ব যাত্রীরা

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। এ নৌপথে চলা ফেরিগুলোয় প্রায়ই মধ্যরাতে বসে জুয়ার আসর। তিন তাসের সে জুয়ার আসরে লোভে পড়ে টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়াচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা।

অনেক সময় জুয়াড়িরা যাত্রীদের কাছ থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেন বলে অভিযোগ আছে। সর্বস্ব খোয়ানো যাত্রীরা এটিকে নিছক দুর্ঘটনা ও ব্যক্তিগত সম্মানের ভয়ে পুলিশ প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ না করেই চলে যাচ্ছেন গন্তব্যে। আবার প্রকাশ্যে জুয়ার আসর বসলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যত উদ্যোগ নেই। ফলে নির্বিঘ্নে আসর বসিয়ে যাচ্ছেন জুয়াড়িরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে চলাচলকারী ফেরিতে প্রতি রাতে চার শতাধিক নৈশ কোচসহ বিভিন্ন ধরনের সহস্রাধিক যানবাহন পারাপার হয়। এ নৌপথে অন্তত ২০-২৫ জনের ৩টি জুয়াড়ি চক্র নির্বিঘ্নে ফেরিতে জুয়ার আসর পরিচালনা করছে।

সম্প্রতি এক মধ্যরাতে পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে যাওয়ায় রো রো ফেরি শাহ জালালের ডেকের ওপর বলা হচ্ছে—‘হায়, হায়, লাগলেই ডাবল, লাগলেই ডাবল।’ কাছাকাছি গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ-ছয়জন জুয়াড়ি বাতি জ্বালিয়ে তিনটি তাস দিয়ে জুয়ার আসর বসিয়েছেন। তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে খেলায় অংশ নিচ্ছেন নৈশ কোচের কয়েক যাত্রী। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে একাধারে চলে এ আসর। ফেরি ঘাটে ভেড়ার আগেই আসরের বাতি নিভিয়ে মুহূর্তেই সটকে পড়েন তাঁরা।

এ সময় পূর্বাশা পরিবহনের মেহেরপুরগামী যাত্রী মোবারক হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি এ চক্রের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা জিতলেও পরবর্তী তিনবারে ৩০ হাজার টাকা খোয়ালাম।’ একই বাসের যাত্রী আলমগীর বলেন, ‘আমি প্রথম দুবার ৫ হাজার করে ১০ হাজার টাকা জেতার পর খেলা বাদ দিতে চাই। পরে পাশে থাকা এ চক্রের লোকজন আমাকে জোরপূর্বক খেলতে বাধ্য করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উল্টো তাঁদের কাছে পনেরো হাজার টাকা হেরে যাই।’

ঘণ্টাখানেক পর একই ফেরিতে ফেরার পথে চোখে পড়ে একই দৃশ্য। এ চক্রের একজনকে জুয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘চুপ থাকেন।’

ফেরিতে ফল বিক্রেতা জামাল মুন্সি বলেন, ‘এ নৌপথে ফেরিতে জুয়া খেলা আজ নতুন নয়। বিষয়টি চলে আসছে দীর্ঘদিন। প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও এখন আর কিছু কয় না। বোঝেন তো সবই ম্যানেজ। আপনি কেন খামাখা ঝামেলা পাকাচ্ছেন?’

আরিফুর নামের নৈশ কোচের এক চালক বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ নৌপথ ও ফেরিতে পুলিশি টহল না থাকায় জুয়ারি চক্র প্রতি রাতে যাত্রীদের এভাবে সর্বনাশ করার সুযোগ পাচ্ছে।

এ নৌপথে চলাচলকারী ফেরির কয়েকজন মাস্টার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘উভয় ঘাট এলাকার কিছু প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় জুয়ারি চক্রের সদস্যরা প্রায় রাতেই ফেরিতে উঠে এমন অপকর্ম চালান। তাঁদের বিরুদ্ধে তাঁরা গোপনে নৌ পুলিশকে জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না। পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তাঁরা উল্টো শঙ্কায় থাকেন বলে জানান।

পাটুরিয়া ঘাট নৌ থানা-পুলিশের পরিদর্শক আবু বক্কর সিদ্দিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ফেরিতে জুয়া খেলার ব্যাপারে লোকমুখে শুনলেও এ পর্যন্ত ভুক্তভোগী কারও কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে সম্প্রতি ফেরিতে জুয়াড়ি চক্রের ছয় সদস্যকে আটক করে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট থানায় একটি মামলা করেছি।’

শিবালয় থানার ওসি মো. শাহিন বলেন, ‘আমি চলতি মাসের প্রথমে এ থানায় যোগদান করেছি। এ বিষয়ে এখনো কিছু শুনি নাই। আমার থানা এলাকার কেউ এ চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে দৌলতদিয়া ঘাট নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. জাকির হোসেন ফেরিতে জুয়া খেলার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, জনবল-সংকটের কারণে ফেরিতে পুলিশি পাহারা দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে পুলিশের একটি দল ফেরিঘাট এলাকায় নিয়মিত নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। যে ঘাটের ফেরিতে পুলিশ থাকে না, সেই ফেরিতে এসব অপকর্ম চলে। গত এক মাসে (জানুয়ারিতে) এ চক্রের ১৬ সদস্যের বিরুদ্ধে ৩টি আলাদা মামলা করা হয়েছে।

জাকির হোসেন বলেন, ফেরিতে জুয়াড়ি চক্রের বর্তমান সদস্যদের তালিকায় দৌলতদিয়ার সাইনবোর্ড এলাকার জামাল, শাহাদাৎ মেম্বার পাড়া এলাকার শাহজাহান মোল্লা, ঘাটের টাওয়ারের পেছনে মোহন রেজাউল করিম, উত্তর দৌলতদিয়ার লতিফ কাজী, বাহির চর দৌলতদিয়ার মাদার কাজী, হোসেন শিকদার, ইদ্রিস আলী পাড়ার আলাই, শাহাদাৎ মেম্বার পাড়ার সাগরসহ অন্তত ১৫-২০ জনের নাম রয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত