Ajker Patrika

হাততালি নয়, হস্তশিল্পেই জীবিকা

শিপুল ইসলাম, রংপুর
Thumbnail image

রংপুরের সানি, শশী কিংবা সুবর্ণা— তাঁরা সবাই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তাঁরা একসময় জীবিকা নির্বাহের জন্য হাট-বাজার-বাসস্ট্যান্ডে কিংবা বিয়েবাড়িতে হাততালি দিয়ে চাঁদা তুলতেন। কেউ কেউ সাহায্যের হাত বাড়াতেন। অনেকে গালমন্দ, এমনকি মারধরও করতেন। ঠাট্টা-টিটকারি, তিরস্কার এসব তো নিত্যসঙ্গী ছিল তাঁদের। তবে এখন আর আগের সেই অবস্থানে নেই তাঁরা। যে হাত বাড়িয়ে দিতেন খুচরা পয়সা পেতে, সেই হাতই এখন কর্মক্ষম। কুটিরশিল্পের কাজ করে তাঁরা নিজের মুখের অন্ন জোগাচ্ছেন। নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের দেখভাল করছেন। ভাইবোনদের পড়াশোনার ভার নিচ্ছেন, কেউ ধরেছেন সংসারের হাল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সীমা আক্তার নামের তৃতীয় লিঙ্গের একজন বলেন, ‘হস্তশিল্পের কাজ করে মা-বাবা, ভাইবোনদের খরচ চালাচ্ছি। এখন নানা অঙ্গভঙ্গি করে মানুষের কাছে আর হাত পাততে হয় না। আমরা শ্রম খাটি। এর বিনিময়ে রোজগার করা টাকায় ডাল-ভাত খাই। এ অনেক শান্তির, তা বুঝতে পেরেছি। এখন অনেক ভালো আছি। আর কেউ আমাদের গালমন্দ করেন না। বরং প্রতিবেশী, স্বজন, বন্ধুরা শ্রদ্ধার চোখে দেখে।’

সীমাদের জীবনে এমন পরিবর্তনের উদ্যোগের নায়ক তাঁদের গুরুমা আনোয়ারা ইসলাম। তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে ‘ন্যায় অধিকার হিজড়া উন্নয়ন সংস্থা’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। এ সংগঠনের মাধ্যমে রংপুরের নজরুল চত্বর এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের হস্ত কুটিরশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, ফুলদানি, মাটির কার্টেল, কয়েলদানি, কলমদানিতে নকশাসহ বিভিন্ন ধরনের শোপিস তৈরি করা শিখছেন তাঁরা। এসব কাজ করে দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয় তাঁদের। অন্যদিকে এসব হস্তশিল্পসামগ্রী ক্রয় করে রূপায়ণ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

আনোয়ারা ইসলাম বলেন, ‘আমরাও মানুষ। মানুষ হয়ে মানুষের কাছে হাত পাতা কতটা যন্ত্রণার—এটা শুধু তাঁরাই বোঝেন, যাঁরা এমন পরিস্থিতিতে পড়েন। আমি হিজড়াদের হাত পেতে চাঁদা তোলার থেকে বের করে আনার ক্ষুদ্র চেষ্টা করছি। শতাধিক হিজড়া এখন হস্তশিল্পের কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে কারুপণ্যে ২০ জন চাকরি করছেন। তাঁরা নিজেদের খরচ বাদেও পরিবারে অর্থের জোগান দিচ্ছেন। সংগঠনটিকে ২০১৭ সালে সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে রংপুর বিভাগের চার শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রয়েছেন।

তাঁরা প্রতি মাসে সংগঠনের তহবিলে ২০০ টাকা করে জমা রাখেন। এ টাকা তাঁদের ও সমাজের উন্নয়নকাজে ব্যয় করা হয়।’ 
আগে মানুষের কাছে হাত পাতলেও বদরগঞ্জের কোহিনুর বেগম আট মাস ধরে হস্তশিল্পের কাজ করছেন। কোহিনুর বলেন, ‘কাজ করে দুই টাকা রোজগার করে বেঁচে আছি। এসব হয়েছে গুরুমা আনোয়ারার কল্যাণে। তাঁর কারণেই আজ আয়ের বাড়তি টাকা আমার পরিবারকেও দিতে পারছি।’  

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মারুফা আক্তার মিতু বলেন, ‘সরকারি বড় বিল, জলাশয়, কিংবা খাসজমি যদি আমাদের লিজ দেওয়া হতো, তাহলে আমরা সেখানে মাছ, হাঁস-মুরগি, সবজি, ঘাস চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতাম।’

এ বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘আনোয়ারাদের কার্যক্রম দেখেছি। তাঁরা নিজেদের বদলাতে চান। হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলছেন। তৃতীয় লিঙ্গের সবার উচিত তাঁদের অনুসরণ করা।’ 

একই কথা জানান আনোয়ারা ইসলামও। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হওয়া জরুরি। আমরা পরিবর্তন 
হতে তৈরি, সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত