Ajker Patrika

গেন্ডারিয়ায় ডিআইটি পুকুর দখল করে দোকানপাট

আয়নাল হোসেন, ঢাকা
Thumbnail image

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় ডিআইটি পুকুর দখল করে সেখানে দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ভাড়া বাবদ মাসে কয়েক লাখ টাকা আদায় করছেন এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুর রহমান ওরফে শহীদ কমিশনার। পুকুরটি নিয়ে মামলাও আছে।

গেন্ডারিয়া ডিআইটি পুকুর একসময় স্থানীয় মানুষের গোসল, থালাবাসন ধোয়া, গরু-বাছুর গোসল করানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে পুকুরটিতে ঢোকার উপায় নেই। চারপাশ দখল করে সেখানে হোটেল, রেস্তোরাঁ, স্বর্ণের দোকান, ফুচকা-চটপটির দোকানসহ নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। পূর্ব পাশে রিকশার কয়েকটি গ্যারেজ বানিয়ে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। পশ্চিম পাশে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় বানানো হয়েছে। শহীদ কমিশনারের হয়ে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি এসব স্থাপনা থেকে ভাড়া আদায় করেন।

পুকুরে ঢোকার জন্য দক্ষিণ পাশে কিছুটা ফাঁকা। সেখানে সিঁড়িঘাট দিয়ে নেমে মহল্লার অনেক লোক গোসল করেন। ভ্যানচালক আবদুল খালেক ২০ বস্তা পুরোনো ইট-সুরকি পুকুরে ফেলতে এসেছেন। তিনি জানান, পাশের মসজিদের ইট-সুরকি পুকুরে ফেলতে বলা হয়েছে। পাশে দা-বঁটি তৈরি করছেন শাহ আলম মিয়া। তিনি জানান, বাবু মিয়ার কাছ থেকে তিনি মাসিক ৩ হাজার টাকায় দোকান ভাড়া নিয়েছেন।

পুকুর দখল হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) কামরুল ইসলাম বলেন, গেন্ডারিয়া ডিআইটি পুকুরের মালিক রাজউক। এটি নিয়ে মামলা চলছে। পুকুরটি দখলমুক্ত করতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুর রহমান শহীদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, পুকুরের জায়গায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি। পুকুর ঠিকই আছে। পুকুরের পাড়ে ৮-৯ ফুট জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এই জমির মালিক জাকির হোসেন, যিনি ২৮ বছর মামলা চালিয়ে রায় পেয়েছেন। তবে রাজউক থেকে নামজারি করা হয়নি।

জাকির হোসেন বলেন, ‘পুকুরটির মালিক আমি। একটি চক্র সরকারি পুকুর বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তবে পুকুরটি ভরাট না করে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে।’
জানা গেছে, গেন্ডারিয়া পুকুর খনন করা হয় ব্রিটিশ আমলে। তখন গেন্ডারিয়া থেকে যাত্রাবাড়ী, ধোলাইখাল, সায়েদাবাদ ও কুতুবখালী দিয়ে মানুষ নৌকায় যাতায়াত করত। কালের বিবর্তনে গেন্ডারিয়ার জলাধার বিলীন হয়ে যায়। ১৯৯২ সালে তৎকালীন ডিআইটি গেন্ডারিয়া এলাকার ১৩ দশমিক ৫৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে। সেখানে দুই একর পরিমাণ একটি পুকুর ছিল।

সম্প্রতি গেন্ডারিয়া এলাকায় গিয়ে পুকুরের অবস্থান জানতে চাইলে কয়েকজন রাস্তা দেখিয়ে দেন। তবে কাছে গিয়েও পুকুর খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে একটি কলাপসিবল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, পুকুরে মাছের জন্য খাবার দিচ্ছেন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের এক লোক। স্থানীয় কয়েকজন জানান, পুকুরটি এলাকাবাসীর প্রাণ ছিল। দিনে সহস্রাধিক মানুষ এখানে গোসল করত। আশপাশে কোথাও আগুন লাগলে এই পুকুরের পানিই ছিল ভরসা।  
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা বলেন, ‘এই পুকুরের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িত। ছোটবেলায় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কত সাঁতার কেটেছি! কিন্তু ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কবলে পুকুরটি আজ হারিয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন পুকুরের চারপাশ ছোট হয়ে আসছে।’

মহানগর, বিভাগীয় শহর ও সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০০০ সালে প্রণীত আইনের ৫ ধারায় বলা আছে, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এ ছাড়া এই ধরনের জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। আইনে শাস্তির বিষয়ে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

গেন্ডারিয়ায় পুকুরের চারপাশে স্থাপনা বানিয়ে ভাড়া দেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারে তাঁদের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। গেন্ডারিয়া পুকুরটির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, গেন্ডারিয়ার জমি ডিআইটি অধিগ্রহণ করেছিল। তবে যে কাজের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল সে কাজে ব্যবহার না করায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে জমির প্রকৃত মালিক মামলা করায় সেটি ফেরত দেওয়া হয়। তবে আদালতের রায় যা-ই হোক কোনোভাবেই পুকুর বা জলাশয় ভরাট করতে পারবে না। 

মানববন্ধন করতে দেয়নি পুলিশ
শ্যামপুর-কদমতলী প্রতিনিধি জহিরুল আলম পিলু জানান, ঐতিহ্যবাহী এই পুকুর দখলের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার এলাকাবাসীর উদ্যোগে এক মানববন্ধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় কর্মসূচি স্থগিত করেন উদ্যোক্তারা। তারপরও প্রতিবাদকারী ও অভিযুক্ত দখলদারদের পক্ষে বেশ কিছু লোক বেলা ১১টায় পুকুরপাড়ে সমবেত হয়। উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ তাদের শান্ত থাকতে বলে।

শ্যামপুর থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আশঙ্কার ইঙ্গিত পাই। তাই ফোর্স নিয়ে উপস্থিত হই।’

মানববন্ধনের উদ্যোক্তা ইব্রাহিম আহমেদ রিপন বলেন, ‘৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাহানা আক্তার ও তাঁর পিতা সাইদুর রহমান শহীদ পুকুরটি ভরাট করার পাঁয়তারা করছেন। তাঁরা পুকুরের চারপাশে দোকান বানিয়ে ভাড়া দেন। আমরা পুকুরটি দখলমুক্ত চাই।’

এ ব্যাপারে কাউন্সিলর সাহানা আক্তার বলেন, ‘রিপন নদী দখলের পাশাপাশি এই পুকুরটিও দখলের পাঁয়তারা করছেন। আমি এই পুকুরটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এর চারপাশের আবর্জনা নিজ অর্থ দিয়ে পরিষ্কার করি। এখানে দখল করার প্রশ্নই আসে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত