রাজীব কুমার সাহা
আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে অন্যতম ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘তালকানা’; বিশেষ করে বাংলা বাগধারার হাত ধরে আমরা প্রায় সবাই এ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। পরিস্থিতির প্রসঙ্গভেদে সাধারণত তালকানা শব্দটি আমরা কোনো ব্যক্তির চারিত্রিক বা আচরণগত কোনো দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা অর্থে ব্যবহার করি। কিন্তু শব্দটির ব্যুৎপত্তি কোথা থেকে? বাংলায় তাল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তালকানা শব্দের সঙ্গে গাছের তালের সম্পর্ক রয়েছে। আসলে কি তাই? তালকানা শব্দের ব্যুৎপত্তিতে তালগোল না পাকিয়ে চলুন জেনে নিই তালকানা শব্দের তালঠিকানা।
সংস্কৃত ‘তাল’ এবং বাংলা ‘কানা’ শব্দ সহযোগে গঠিত হয়েছে ‘তালকানা’ শব্দটি। এটি বিশেষণ পদ। আক্ষরিকভাবে তালকানা শব্দের অর্থ হলো সংগীতের তালজ্ঞান নেই এমন। আর আলংকারিকভাবে এর অর্থ হলো কাণ্ডজ্ঞানহীন, অসাবধান বা বিষয়জ্ঞানশূন্য। ‘কাকতালীয়’, ‘তালমাতাল’, ‘তালদিঘি’ প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে গাছের তালের সরাসরি সম্পর্ক থাকলেও ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে তালকানা শব্দের সঙ্গে গাছের তালের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি তালের রস খেয়ে কেউ ‘বেতালা’ হলেও তাকে তালকানা বলা হয় না। মূলত সংগীতের তাল থেকেই তালকানা শব্দের উৎপত্তি।
তাল সংগীত, বাদ্য ও নৃত্যের গতি বা লয়ের স্থিতিকাল। উল্লিখিত তিনটি ক্ষেত্রেই তালের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তাল রচনা করা হয়। তাল দুই প্রকার—সমপদী ও বিষমপদী। তালের মাত্রাবিভাগ সমান হলে সমপদী, যেমন একতাল, ত্রিতাল, চৌতাল প্রভৃতি। আবার তাল অসমান হলে বিষমপদী, যেমন তেওড়া, ধামার, ঝাঁপতাল প্রভৃতি। একটি তালকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়, যাকে বলা হয় তালবিভাগ। ত্রিতালে চারটি বিভাগ এবং দাদরা ও কাহারবা তালে দুটি করে বিভাগ রয়েছে। যে মাত্রা থেকে তাল শুরু করা হয়, তাকে ওই তালের ‘সম’ বলে। তালের প্রথম বিভাগের প্রথম মাত্রায় তালি দিয়ে ‘সম’ দেখানো হয়। তালের যে বিভাগে তালি দেওয়া হয় না, তা ‘খালি’ বা ‘ফাঁক’তাল নামে পরিচিত। এই ফাঁকতাল শব্দেরও আলংকারিক একটি অর্থ রয়েছে। সে গল্প না হয় আরেক দিন করব। সংগীতে তাল অপরিহার্য, তাই তালকে বলা হয় সংগীতের প্রাণ। সংগীতে প্রচলিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তাল হলো দাদরা, কাহারবা, আড়াঠেকা, ঝাঁপতাল, সুরতাল বা সুরফাঁকতাল, চৌতাল, একতাল, আড়াখেমটা, ধামার, ত্রিতাল প্রভৃতি। তালের কাজ সংগীতে গতির সমতা রক্ষা করা। এই গতিকে বলা হয় লয়। সংগীত ও লয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাল ও লয় ভঙ্গ হলে সংগীত বা নৃত্যের রসভঙ্গ হয়। তাল ও লয় যিনি ভঙ্গ করেন, প্রকৃত অর্থে তিনিই হলেন মূল তালকানা। কিন্তু আলংকারিক বিচারে আমরা এখন কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যক্তিকেই তালকানা বলে অভিহিত করি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কয়েকটি তাল হলো ঝম্পক, ষষ্ঠী, রূপকড়া, নবতাল, নবপঞ্চ তাল প্রভৃতি। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামও একাধিক তাল রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নবনন্দন, প্রিয়াছন্দ, মণিমালা ছন্দ, মন্দাকিনী ছন্দ, মঞ্জুভাষিণী তাল প্রভৃতি। কবিগুরু কেবল সংগীতের তালই রচনা করেননি, তালকানা শব্দের সফল প্রয়োগও করেছেন তাঁর রচিত গল্পগুচ্ছের ‘পয়লা নম্বর’ ছোটগল্পে। এ ছাড়া দাশরথি রায়ের ‘পাঁচালী’তে আমরা তালকানা শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করি।
দৈনন্দিন জীবনাভিজ্ঞতায় দেখতে পাই, আমাদের চারপাশে তালকানা লোকের অভাব নেই। ঠিক যে সময়ে যে কাজটি করা দরকার, তালকানা ব্যক্তি করেন ঠিক এর উল্টোটি। আর এখানেই তিনি হয়ে ওঠেন অসাবধানি বা কাণ্ডজ্ঞানহীন। সংগীতে যেমন সুর-তাল-লয় ঠিক হওয়া জরুরি, তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সুর-তাল-লয়ও ঠিক না রাখতে পারলে প্রত্যাশিত সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব নয়। সুতরাং তালকানা না হয়ে যুগপৎ জীবন এবং সংগীতে তালজ্ঞান ঠিক রাখুন।
লেখক: রাজীব কুমার সাহা, আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে অন্যতম ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘তালকানা’; বিশেষ করে বাংলা বাগধারার হাত ধরে আমরা প্রায় সবাই এ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। পরিস্থিতির প্রসঙ্গভেদে সাধারণত তালকানা শব্দটি আমরা কোনো ব্যক্তির চারিত্রিক বা আচরণগত কোনো দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা অর্থে ব্যবহার করি। কিন্তু শব্দটির ব্যুৎপত্তি কোথা থেকে? বাংলায় তাল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তালকানা শব্দের সঙ্গে গাছের তালের সম্পর্ক রয়েছে। আসলে কি তাই? তালকানা শব্দের ব্যুৎপত্তিতে তালগোল না পাকিয়ে চলুন জেনে নিই তালকানা শব্দের তালঠিকানা।
সংস্কৃত ‘তাল’ এবং বাংলা ‘কানা’ শব্দ সহযোগে গঠিত হয়েছে ‘তালকানা’ শব্দটি। এটি বিশেষণ পদ। আক্ষরিকভাবে তালকানা শব্দের অর্থ হলো সংগীতের তালজ্ঞান নেই এমন। আর আলংকারিকভাবে এর অর্থ হলো কাণ্ডজ্ঞানহীন, অসাবধান বা বিষয়জ্ঞানশূন্য। ‘কাকতালীয়’, ‘তালমাতাল’, ‘তালদিঘি’ প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে গাছের তালের সরাসরি সম্পর্ক থাকলেও ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে তালকানা শব্দের সঙ্গে গাছের তালের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি তালের রস খেয়ে কেউ ‘বেতালা’ হলেও তাকে তালকানা বলা হয় না। মূলত সংগীতের তাল থেকেই তালকানা শব্দের উৎপত্তি।
তাল সংগীত, বাদ্য ও নৃত্যের গতি বা লয়ের স্থিতিকাল। উল্লিখিত তিনটি ক্ষেত্রেই তালের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তাল রচনা করা হয়। তাল দুই প্রকার—সমপদী ও বিষমপদী। তালের মাত্রাবিভাগ সমান হলে সমপদী, যেমন একতাল, ত্রিতাল, চৌতাল প্রভৃতি। আবার তাল অসমান হলে বিষমপদী, যেমন তেওড়া, ধামার, ঝাঁপতাল প্রভৃতি। একটি তালকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়, যাকে বলা হয় তালবিভাগ। ত্রিতালে চারটি বিভাগ এবং দাদরা ও কাহারবা তালে দুটি করে বিভাগ রয়েছে। যে মাত্রা থেকে তাল শুরু করা হয়, তাকে ওই তালের ‘সম’ বলে। তালের প্রথম বিভাগের প্রথম মাত্রায় তালি দিয়ে ‘সম’ দেখানো হয়। তালের যে বিভাগে তালি দেওয়া হয় না, তা ‘খালি’ বা ‘ফাঁক’তাল নামে পরিচিত। এই ফাঁকতাল শব্দেরও আলংকারিক একটি অর্থ রয়েছে। সে গল্প না হয় আরেক দিন করব। সংগীতে তাল অপরিহার্য, তাই তালকে বলা হয় সংগীতের প্রাণ। সংগীতে প্রচলিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তাল হলো দাদরা, কাহারবা, আড়াঠেকা, ঝাঁপতাল, সুরতাল বা সুরফাঁকতাল, চৌতাল, একতাল, আড়াখেমটা, ধামার, ত্রিতাল প্রভৃতি। তালের কাজ সংগীতে গতির সমতা রক্ষা করা। এই গতিকে বলা হয় লয়। সংগীত ও লয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাল ও লয় ভঙ্গ হলে সংগীত বা নৃত্যের রসভঙ্গ হয়। তাল ও লয় যিনি ভঙ্গ করেন, প্রকৃত অর্থে তিনিই হলেন মূল তালকানা। কিন্তু আলংকারিক বিচারে আমরা এখন কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যক্তিকেই তালকানা বলে অভিহিত করি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কয়েকটি তাল হলো ঝম্পক, ষষ্ঠী, রূপকড়া, নবতাল, নবপঞ্চ তাল প্রভৃতি। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামও একাধিক তাল রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নবনন্দন, প্রিয়াছন্দ, মণিমালা ছন্দ, মন্দাকিনী ছন্দ, মঞ্জুভাষিণী তাল প্রভৃতি। কবিগুরু কেবল সংগীতের তালই রচনা করেননি, তালকানা শব্দের সফল প্রয়োগও করেছেন তাঁর রচিত গল্পগুচ্ছের ‘পয়লা নম্বর’ ছোটগল্পে। এ ছাড়া দাশরথি রায়ের ‘পাঁচালী’তে আমরা তালকানা শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করি।
দৈনন্দিন জীবনাভিজ্ঞতায় দেখতে পাই, আমাদের চারপাশে তালকানা লোকের অভাব নেই। ঠিক যে সময়ে যে কাজটি করা দরকার, তালকানা ব্যক্তি করেন ঠিক এর উল্টোটি। আর এখানেই তিনি হয়ে ওঠেন অসাবধানি বা কাণ্ডজ্ঞানহীন। সংগীতে যেমন সুর-তাল-লয় ঠিক হওয়া জরুরি, তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সুর-তাল-লয়ও ঠিক না রাখতে পারলে প্রত্যাশিত সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব নয়। সুতরাং তালকানা না হয়ে যুগপৎ জীবন এবং সংগীতে তালজ্ঞান ঠিক রাখুন।
লেখক: রাজীব কুমার সাহা, আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৭ দিন আগেআধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
০৮ মে ২০২৫