Ajker Patrika

লক্ষ্মীপুরের ত্রাস জিহাদীর গডফাদার কারা

সাইফুল মাসুম ও আব্বাছ হোসেন, লক্ষ্মীপুর থেকে
লক্ষ্মীপুরের ত্রাস জিহাদীর গডফাদার কারা

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নে ২৫ বছরে খুন হয়েছে ২৪ জন। সবশেষ গত ২৫ এপ্রিল রাতে জোড়া খুনের ঘটনায় বশিকপুর নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এলাকায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আছে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, মাদক ও অস্ত্রের কারবার এবং চাঁদাবাজির মতো ঘটনা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, বশিকপুরে এমন অস্থিতিশীলতার শুরু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। তখন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে সশস্ত্র গ্যাং বা গোষ্ঠী। সেই গোষ্ঠীগুলো থেকে তৈরি হয় আরও কিছু নতুন ছোট গ্রুপ। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অনেক গ্রুপ নির্মূল হলেও তিন দশক ধরে অবস্থান ধরে রেখেছে ‘জিহাদী বাহিনী’। সম্প্রতি জোড়া খুনের মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে এই বাহিনীর প্রধান আবুল কাশেম জিহাদীকে।

র‍্যাব-১১-এর নোয়াখালী ক্যাম্পের কোম্পানি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাহমুদুল হাসান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমাম হত্যা মামলার প্রধান আসামি আবুল কাশেম জিহাদী ১৯৯৬ সালে নিজের নামে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে। তার বাহিনীতে বর্তমানে ৩০০ সদস্য আছে। তাদের মাধ্যমে সে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।’ 

ছিঁচকে চোর থেকে জিহাদী বাহিনীর প্রধান
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বশিকপুর ইউনিয়নের রশীদপুর গ্রামের আবুল কাশেম শৈশবে ট্রাকের হেলপার, দারোয়ান ও দিনমজুরের কাজ করেছেন। ছোটখাটো চুরিও করতেন। ১৯৯০ সালে ডাকাতি করতে গিয়ে দোনলা বন্দুকসহ পুলিশের হাতে আটক হয়ে প্রথমবার আলোচনায় আসেন। ওই ঘটনায় দুই বছরের মতো জেল খেটে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। পরে দেশে ফিরে জড়িয়ে যান জামায়াতের রাজনীতিতে। নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেন জিহাদী।

১৯৯৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপির সমর্থনপুষ্ট প্রার্থী আবুল বাশারের পক্ষে কাজ করেন। ভোটের দিন রকেট লঞ্চার নিক্ষেপ করে নতুন করে আলোচনায় আসেন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে শতাধিক সদস্য নিয়ে গড়ে তোলেন ‘জিহাদী বাহিনী’। তখন থেকেই জড়িয়ে পড়েন খুনখারাবিতে। ১৯৯৮ সালে প্রকাশ্যে দফাদার আবুল কাশেমের পায়ে গুলি করেছিলেন। তখন মামলা থেকে রেহাই পেতে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। তাঁর যোগদানে ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। আওয়ামী লীগের সমর্থনে জিহাদী দুইবার ইউপি চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। সবশেষ নির্বাচনে তিনি দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। 

যাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় অপ্রতিরোধ্য
বশিকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আবুল কাশেম জিহাদী তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে হত্যা, নির্যাতন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। তাঁর বিরুদ্ধে এক ডজন খুনের অভিযোগ আছে। ১৯৯৮ থেকে জিহাদীর বিরুদ্ধে ৯৪টি মামলা হয়েছে। বর্তমানে ২০টির বেশি মামলা বিচারাধীন।

র‍্যাব-১১-এর নোয়াখালী ক্যাম্পের কোম্পানি অধিনায়ক জানান, কাশেম জিহাদী ২০১৩ সালে দত্তপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন শামিম, ২০০০ সালে আইনজীবী নুরুল ইসলাম, দত্তপাড়া এলাকার আবু তাহের, বশিকপুরের নন্দীগ্রামের মোরশেদ আলম, করপাড়ার মনির হোসেন, উত্তর জয়পুরের সেলিম ভূঁইয়া ও কামাল হোসেন হত্যা মামলারও প্রধান আসামি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, কাশেম জিহাদী রাজনৈতিক প্রভাবে পার পেয়েছেন অনেক মামলা থেকে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর থেকে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন প্রভাবশালী নেতা প্রয়াত আবু তাহেরের। ২০১৫ সাল থেকে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা পান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের (বর্তমানে সংসদ সদস্য) কাছ থেকে।

এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের মন্তব্য জানতে হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার কল করে এবং পরে বার্তা দিলেও সাড়া দেননি।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, ‘আমি কোনো সন্ত্রাসীকে পৃষ্ঠপোষকতা করি না। অপরাধ প্রমাণিত হলে আবুল কাশেম জিহাদীকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হবে। কাশেম আগে চন্দ্রগঞ্জ থানার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল, কয়েক মাস আগে আলাউদ্দিন হত্যার পর সাধারণ সম্পাদক (নুর উদ্দিন চৌধুরী) তাঁকে সহসভাপতি করেছেন।’

স্বার্থের দ্বন্দ্বে জোড়া খুন
বশিকপুরের পোদ্দারবাজার এলাকায় গত ২৫ এপ্রিল রাতে যুবলীগ নেতা নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিবকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কাশেম জিহাদী ও মাহফুজুর রহমানের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের জের ধরেই বশিকপুরে এই জোড়া খুন ঘটে। কাশেম জেহাদী গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমান। নির্বাচনে কাশেমের ভরাডুবি হওয়ার পর থেকেই কাশেম ও তাঁর বাহিনীর সঙ্গে মাহফুজ-নোমান পক্ষের দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দেয়। কাশেম জিহাদী গত ২০ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে নোমানকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন।
নিহত নোমানের বড় ভাই ও বশিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘কাশেম জিহাদী আমার ভাইকে খুন করেছে।

সিনেমার স্টাইলে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। তাকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। যাঁরা কাশেমকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, অর্থ জোগান দিয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে। বড় কারও ছত্রচ্ছায়ায় এখনো জিহাদী বাহিনীর সন্ত্রাসীরা বিচরণ করছে। যাঁরা এদের মদদ দিচ্ছেন, তাঁদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

লাপাত্তা কাশেম জিহাদী
নোমান ও রাকিব হত্যা মামলায় র‍্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে গত সোমবার পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে মামলার প্রধান আসামি আবুল কাশেম জিহাদী ধরা পড়েননি।

আবুল কাশেম জিহাদীকে এত বছরেও কেন আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলার পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, ‘আপাতত বলতে চাই, মামলা নিয়ে আছি। মামলার তদন্ত করছি। এর বাইরে কিছু বলতে পারব না। কারণ আট মাস হয়েছে আমি এখানে এসেছি। তিন দশকে কী হয়েছে, সেটা নিয়ে এখনো স্টাডি করিনি। তবে জোড়া খুনের হত্যাকারীদের ধরার জন্য তৎপর আছি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে আবুল কাশেম জিহাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। রশীদপুরে গিয়ে তাঁর বসতঘর তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। তাঁর একাধিক ফোন নম্বরে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। ২০ বছর ধরে কাশেম জিহাদীর আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন অ্যাডভোকেট নুরুল হুদা পাটোয়ারী। তিনি জিহাদীর বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এত মামলা, এত খুনের অভিযোগ! তাঁর বিরুদ্ধে অনেক আগেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। এতে স্পষ্ট বুঝতে পারি, তাঁর পেছনে অনেক পৃষ্ঠপোষক আছে। পৃষ্ঠপোষকদের খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাঁরা সেখানকার রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। জিহাদী সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে আধিপত্য বজায় রেখেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর না হলে অপরাধকাণ্ড নিরসন করা সম্ভব হবে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১০২ এসি ল্যান্ডকে প্রত্যাহার

গাজীপুরে একটি সংসদীয় আসন বাড়বে, কমবে বাগেরহাটে, ইসির খসড়া চূড়ান্ত

বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কমছে, সবুজসংকেত যুক্তরাষ্ট্রের

গণপূর্তের ৫ প্রকৌশলী ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের ১ স্থপতি বরখাস্ত

স্বামীর মৃত্যুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েও যাবজ্জীবন এড়াতে পারলেন না রসায়নের অধ্যাপক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত