Ajker Patrika

ওরা আমাদের ‘ভালো’ চায়

সানজিদা সামরিন
ওরা আমাদের ‘ভালো’ চায়

আগে ঘরানা দুটো ছিল বা দুই পক্ষ। একপক্ষ উচ্চশিক্ষিত ঘরোয়া নারী খুঁজত বিয়ের পাত্রী হিসেবে। পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেও লক্ষ্মীমন্ত সংসারী নারী হওয়া চাই। বাইরের কাজ পুরুষ করবে আর ঘরের কাজ নারী। অন্যদিকে গুটিকয়েক পুরুষ স্ত্রীর বাইরে কাজ করা, মানে চাকরি করাকে সমর্থন দিতেন, সম্মানও দিতেন, হতেন সহমর্মীও। যাঁরা দিতেন না বা হতেন না; তাঁদের কথা হচ্ছে না।

বর্তমানে নারীদের একটা বড় অংশ বাইরে বের হচ্ছেন; মানে উচ্চশিক্ষার পর ঘরে বসে থাকার কথা খুব কম নারীই ভাবছেন। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, পুরুষেরাও নারীর কর্মজীবনকে ‘না’ বলছেন না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

বাসে আপনার সামনের সিটে, পাশের ফ্ল্যাটে, বন্ধুমহলে বা আত্মীয়ের মধ্য়ে যেসব নারী কর্মজীবী, তাঁদের অনেকেই একটা সমস্যায় রয়েছেন। আবার অনেকে বুঝতেও পারছেন না যে এটা সমস্যা। কারণ তাঁরা জানেন ও বোঝেন, যা বলা হচ্ছে বা যা হচ্ছে, সবই তাঁদের ভালোর জন্য।

নারী ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করবেন। কিন্তু নারী কী কাজ করবেন, কত দূরে গিয়ে কাজ করবেন, কোন ধরনের পেশা বেছে নেবেন, কোন পোস্টে কাজ করবেন, কত বেতনে কাজ করবেন, সন্ধ্যার পর কাজ থাকলে করবেন নাকি করবেন না, পথে যানজট থাকুক বা না থাকুক ঠিক কয়টায় ঘরে পৌঁছাতে হবে, রিকশায় যাবেন নাকি বাসে চড়বেন—এই সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছেন একজন পুরুষ। যাঁদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটছে না, তাঁরা এ লেখাটি এখানেই পড়া শেষ করুন।

২০২৩ সালে এসেও অনেকে ভাবছেন যে নারীর জন্য আদর্শ পেশা হচ্ছে শিক্ষকতা, সরকারি ও ব্যাংকে চাকরি। নারীর জন্য এর চেয়ে নিরাপদ ও ভালো কাজ হতে পারে না। এখানে নারীর জন্য ‘নিরাপদ’ শব্দটাকে যদি বেছে নিই বা বিভিন্ন হয়রানির কথাই হয় তাহলে বলব, আমরা মানুষ হিসেবে যখন সভ্য হয়ে উঠব, তখন হয়তো অন্য কারও হয়রানির কারণ হব না। এর বাইরে আলাদা করে আসলে বলা যাবে না যে নারীর জন্য নিরাপদ বলে আলাদা কোনো সংগঠন রয়েছে। আরও আছে, ‘এই পেশার নারীরা ভালো আর ওই পেশায় ভালো নারীরা কাজ করে না।’ এই ভাগাভাগিগুলোও অনেকটা পুরুষের ঠিক করে দেওয়া, যে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে নারীরাও অন্য নারীকে ভালো বা খারাপের কাতারে ফেলছেন।

অনেক নারীকে দেখি উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পর নিজের পছন্দসই চাকরিটাই করতে পারছেন। কিন্তু নিজের আয়ের অর্থ সংসারে খরচ করছেন না। উপরন্তু হাতখরচের টাকাটাও আশা করছেন পরিবার কি স্বামীর কাছ থেকে। এটা অনেক নারীই উতরাতে পারেননি। ফলে এখানে সাম্যের গান আদৌ গাওয়া যাচ্ছে না। সংসারে মিলেমিশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া কিছুটা থমকে যাচ্ছে, আবার যাচ্ছেও না। কারণ সেই নারী অর্থনৈতিক ছাপ সংসারে না রাখলেও সংসার-সন্তান সামলানোর দায়িত্ব ঠিকই পালন করছেন। যে কারণে নারী কখনো বেকার হয় না!

এবার মুদ্রার অপর পিঠে আসি। কর্মজীবী নারীর স্বামীই আবার কখনো কখনো নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, তাঁর স্ত্রীকে প্রতি মাসে ঠিক কত টাকা সংসারে দিতে হবে। সমান সমান ভাগ হওয়া চাই, সংসারে নারীর খরচও হওয়া চাই দৃশ্যমান খাতে। কিন্তু এই সমান সমান ভাগাভাগিতে কখনো যে অসমান ব্যাপার থাকে তা হলো—স্বামীর বেতন ১০০ টাকা হলে সংসারে তাঁর ব্যয় ৫০ টাকা। অন্যদিকে স্ত্রীর বেতন ৭০ টাকা হলে সংসারে তাঁর স্বামীর সমপরিমাণ ব্যয় ৫০ টাকা। আবার নারীর ক্ষমতায়নে সহমত পোষণকারী পুরুষেরা চাইছেন আত্মনির্ভরশীল নারী সংসারে তাঁর সমান অর্থ খরচ করার পরে নিজের সব খরচও তথা মৌলিক চাহিদা নিজে বহন করুক। আমরা নারীরাও তাই চাই। কিন্তু সমান সমান ভাগের অসমান অঙ্ক বোধগম্য হয় না। শোষণ এখানেও হচ্ছে, কিন্তু ভিন্ন তরিকায়, আধুনিক ঘরানায়।

সংসারে সমপরিমাণ অর্থ খরচের কথা হলো। কিন্তু সমপরিমাণ শ্রম? কর্মক্ষেত্রে সময় ঘণ্টার ব্যাপারটা তো নারী-পুরুষ হিসেবে ভিন্ন হয় না। ব্যাপারটা এমন নয় যে নারী ৫ ঘণ্টা কাজ করেন আর পুরুষ ৮ ঘণ্টা। আবার কাজ শেষে বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রেও নারীর জন্য পথে স্বল্প যানজট আর পুরুষের জন্য অধিক যানজট থাকে এমনও কিন্তু নয়। কিন্তু দিনশেষে বাড়ি ফিরে পুরুষ ক্লান্ত থাকেন। নারীর কোনো ক্লান্তি নেই। নারীর দিকে বরফ দেওয়া ঠান্ডা পানির গ্লাস কে বা কতজনই এগিয়ে দেন সেই ভর সন্ধ্যায়? রান্নাঘরের কেমিস্ট্রি এ সময়ে এসেও কজন পুরুষ বোঝেন? যাঁরা বোঝেন, তাঁদের কথা হচ্ছে না। আবার বিয়ের দিন থেকেই যে বাঙালি নারী মায়ের ভূমিকায় চরিত্র রূপায়ণ করে যান, তাঁরাও হুঁশ করে ক্লান্তিকে তাড়িয়ে দিতে একদমই দ্বিধা করেন না। কারণ এখনো নারীর ক্লান্তিবোধ সমান সমান অপরাধবোধ হয়ে আছে অনেক জায়গায়।

চাকরিবাকরি, ঘর-সংসারের কথা বলে শব্দ খরচা করেই থেমে যেতে পারছি না। ‘আমি চাই তুমিই করো’ ট্রেন্ড চলছে এখন। এটা পুরুষের তৈরি করা ছাঁচ, আধুনিক কায়দায়। ঘরে পুরে রাখা নয়, এবার বাইরে এনে ভিন্ন ছাঁচে গড়া প্রতিমা নারী। ‘নারী তুমি এই পেশায়, এই বেতনে, এই পোস্টে চাকরি করবে। বিসিএস দিতেই হবে। অন্যরা দিচ্ছে। নারী তুমি আন্ডারওয়েট, ওসব পোশাকে ভালো লাগে না। এবার তোমার বাড়তি ওজন কমাও, মেদ কমাও। আপার লিপে লোম কেন, লেজার করাও। বাজার করো, ড্রাইভ করো, সংসার করো, বাচ্চা লালনপালন করো। শ্বশুরবাড়ির মনমতো চলো, পর্দায় থাকো, একনাগাড়ে সব করো। কিন্তু সেসব আমার (পুরুষ) কমান্ডে, আমার পছন্দে, আমার দাগকাটা পরিসরে।’ যদি কোনো নারী বলে বসেন, ‘তাহলে অমন মেয়েকেই বিয়ে করতে, আমি অত সব পারি না।’ উত্তরে তখনই আসে ‘আমি চাই তুমিই করো’। নারীরাও কি কম যাই? সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা এই সময়ে পারফেক্ট ফিগার তো আমাদেরও চাই। চাই সব কটা চোখ আমাকেই ঘিরে থাকুক। ঘিরে থাকুক প্রিয় মানুষটি। জন্ম-জন্মান্তরে গিলে নেওয়া টোপ ছাড়ি কী করে? কী সেই মন্ত্র পড়া টোপ?

‘ও, ওরা, তারা আমার ভালো চায় বলেই...।’

সানজিদা সামরিন, সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত