Ajker Patrika

আধুনিক বাংলাদেশের রূপকারের জন্মদিনে

মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ ও লেখক
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯: ২৩
Thumbnail image

১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ মুজিবুর রহমান ও ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ঘরে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। তিনি শেখ হাসিনা। মা-বাবার আদরের ‘হাচুমণি’। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাজনীতির মানুষ। শেখ হাসিনার রক্তে তাই রাজনীতি। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করলেও জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছে তেমন ছিল না। কোন পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হন, সেদিনের সেই ইতিহাস যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, আমিও তাঁদের একজন। বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের অত্যন্ত দুঃসময়ে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে পদার্পণ করেন।

১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট ট্র্যাজেডির পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় স্বাধীনতাবিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা। এ সময় দেশের আইন-শৃঙ্খলা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে আসে চরম নিপীড়ন-নির্যাতন। কারাগারগুলো কানায় কানায় ভরে যায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তারের ফলে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তো জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশেই প্রবেশ করতে পারেননি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর প্রাক্কালে শেখ হাসিনা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে দেশের লাখ লাখ মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়। সেদিন বাংলাদেশে অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়।

দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নেয় বঙ্গবন্ধুর মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। পঁচাত্তর-পরবর্তী কালপর্বে বাঙালি কান্নার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ যেন কান্নার অধিকার ফিরে পায়। নতুন আশায় বুক বেঁধে নতুনভাবে জেগে ওঠে বাংলার প্রতিবাদী মানুষ।

স্বৈরশাসক এরশাদের পুরো শাসনামলেই আওয়ামী লীগের ওপর দমনপীড়ন চলে। শেখ হাসিনাকেও জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়। আমরা যারা আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী ছিলাম, তারাও এরশাদের বন্দিশালায় বন্দী থেকেছি। চোখ বাঁধা অবস্থায় দিনের পর দিন ক্যান্টনমেন্টে থেকেছি। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হলে এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। দেশদ্রোহী জামায়াতিদের যোগসাজশে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দেশে সীমাহীন দুর্নীতি শুরু করে। মৌলবাদীদের উত্থান ঘটিয়ে মুজিবকন্যাকে হত্যার ঝুঁকিতে ফেলা হয়। বারবার তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল এসব হামলার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। এই হামলায় ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন শত শত। অলৌকিকভাবে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। বিএনপির দুঃশাসনে বাংলাদেশ অস্থির হয়ে উঠলে ১৯৯৬ সালে ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রথমবারের মতো অধিষ্ঠিত হন তিনি। ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই শেখ হাসিনা দেশের ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য মনোনিবেশ করেন। সেই সঙ্গে আর্থসামাজিক উন্নতি ঘটিয়ে ধীরে ধীরে দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। শেখ হাসিনা হত্যা ও বিচারহীনতার পরিবেশ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদাহরণ সৃষ্টি করেন। তাঁর আমলেই জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয় এবং ঘাতকেরা বিচারের মুখোমুখি হয়ে প্রাণদণ্ডসহ নানা দণ্ডে দণ্ডিত হয়; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা বলেই সর্বস্তরের জনগণ মনে করে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এ দেশের রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়। স্বাধীনতার চার দশক পরে হলেও শেখ হাসিনার সরকারই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করে সাজা কার্যকর করেছে। বাংলাদেশে অনেক সরকারই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু কোনো সরকারই জাতির পিতার হত্যার বিচার করার কথা ভাবেনি; বরং অনেকেই চেয়েছে কোনোভাবেই যেন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হয়। এ জন্য জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো কালো আইন তৈরি করে খুনিদের দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে প্রমাণ করে গেছেন—এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনিও যুক্ত ছিলেন। শেখ হাসিনা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। বিশ্বের সব দেশেই অন্যায়-অপরাধ হয়। মানুষের অপরাধপ্রবণতার কারণে রাষ্ট্রে অন্যায়-অপরাধ সংঘটিত হতেই পারে। কিন্তু সেই অন্যায়ের প্রতিকার করা সরকারের দায়িত্ব।

শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, সাহস ও অনমনীয় মনোভাবের কারণেই বাংলাদেশ আজ অনন্য উচ্চতায় স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার শাসনামলই সবচেয়ে দীর্ঘ এবং উন্নয়নমুখী। শেখ হাসিনা গরিব বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর মতো স্বপ্নের সেতু দেশের টাকায় বাস্তবায়ন করে বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রাবন্দর, রূপসা, কালনা, যমুনা নদীতে বড় বড় সেতু সমগ্র বাংলাদেশের চেহারা বদলে দিয়েছে।

শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক খাতেও বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল হলে দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা দরকার। সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে অতীতের স্বৈরশাসন ও সামরিক শাসকেরা যেসব ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন, শেখ হাসিনা সেই সব ঘৃণ্য চক্রান্ত ছিন্ন করে দেশের সংবিধানকে সমুন্নত করেন এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশ পরিচালনা করতে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার শাসনামলে সবকিছু না পেলেও অনেক কিছুই পেয়েছে, এ কথা আজ আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন মধ্যম আয়ের দেশে। অচিরেই আমরা তাঁর নেতৃত্বে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে নিজেদের জায়গা করে নেব। শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই সুনাম অর্জন করেছেন, দেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পাচ্ছেন তা-ই নয়, তিনি আজ বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বৈশ্বিক নানা সংকট নিয়ে তিনি যেভাবে তাঁর অবস্থান জানান দিচ্ছেন, তাতে বিশ্বের অন্য নেতারাও শেখ হাসিনাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

জাতিসংঘ, এর অঙ্গসংগঠন ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তন, নারী ও শিশু অধিকার, রোহিঙ্গা সমস্যা ও বর্তমান যুদ্ধ—সমস্যা সমাধানে তিনি যেভাবে উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন, তাতে বিশ্ব বিবেক জেগে উঠছে। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জননেত্রী আজ বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হয়েছেন—এ কথা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলাদেশের আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক নিজেকে এত উচ্চতায় আসীন করতে পারেননি। আজ বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একই উচ্চতায় অবস্থান করছেন; যা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, এশিয়া মহাদেশের জন্যও অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা।

শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। তিনি আঁধারভেদী আলোকশিখা। বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের ত্রাতা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোটি কোটি বিপন্ন মানুষের মর্মবাণী আজ উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর কণ্ঠে। স্বজন হারানোর চির বেদনায় কাতর হয়েও তিনি মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর অদম্য পথচলাই তাঁকে গন্তব্যের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। আমি দীর্ঘদিন শেখ হাসিনার পাশে থেকে উপলব্ধি করেছি যে দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ভাবনাই তাঁর জীবনের ব্রত। অনেক চড়াই-উতরাই, জেল-জুলুম, গৃহবন্দিত্ব সহ্য করে তিনি ৭৬টি বছর অতিক্রম করে ৭৭তম বছরে পা রাখছেন। তাঁর জন্মদিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত