Ajker Patrika

বঙ্গবাজারে আগুন: ঈদের স্বপ্ন আগুনে ছাই

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১৬: ০৬
Thumbnail image

ঈদের কেনাকাটা কেবল জমতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা থরে থরে পণ্য সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায়। স্বপ্ন দেখছিলেন গত কয়েক বছরের করোনার ক্ষতিটা এবার হয়তো পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু এক সকালে সেই স্বপ্ন পুড়ে ছাই। পথে বসে গেলেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী।

রাজধানীর বঙ্গবাজারে সাতটি মার্কেটে অন্তত ৫ হাজার দোকান গতকাল মঙ্গলবার পুড়ে ছাই হয়েছে। প্রতিটি দোকানে ঈদের আগে পোশাক তোলা হয়েছিল। সব পুড়ে গেছে। দোকানের মালপত্রের সঙ্গে পুড়েছে নগদ টাকাও। ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে নিহতের কোনো খবর গতকাল রাত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে আগুন নেভাতে গিয়ে এবং আগুনের মধ্যে মালপত্র সরানোর সময় আহত হয়েছেন কয়েকজন। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কেউ ষড়যন্ত্র করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবাজার থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র এটি। তাঁরা আর কখনো হয়তো এখানকার দোকানে ফিরতে পারবেন না। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ হয়তো ঠিক নয়। তারপরও তদন্ত করে দেখা হবে–এটি নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা।

গতকাল সকাল ৬টার দিকে বঙ্গবাজারের টিনশেড দোকানে আগুনের সূত্রপাত হয়। ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস দুপুর ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই সব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

এই ঘটনায় অন্তত ৫ হাজার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানান বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির পরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব নিরূপণ করতে পারিনি। তবে ৫ হাজার দোকান পুড়েছে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ কত হবে, সেটা এখনই বলা সম্ভব না।’

তবে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীনের দাবি, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।’ সরেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গবাজারে একসঙ্গে পাশাপাশি ছয়টি মার্কেট। সেগুলো হলো গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, মহানগর কমপ্লেক্স, আদর্শ মার্কেট, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট, ঢাকা মহানগর মার্কেট ও এনেক্সকো টাওয়ার। এই ছয় মার্কেট পুরো আগুনে ছাই। একই আগুনে রাস্তার পশ্চিম পাশে বঙ্গ হোমিও মার্কেটের আরও ২০০ দোকান পুড়েছে।

বঙ্গবাজারে এনেক্সকো টাওয়ার ও বঙ্গ হোমিও মার্কেট ছাড়া বাকি মার্কেটগুলোর দোকান টিন, কাঠ, লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি। ইসলামিয়া মার্কেটের তৈরি পোশাকের দোকানমালিক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘মার্কেটে কাঠের তিনতলা দোকান ছিল। নিচতলা ও দোতলায় মার্কেট, তৃতীয় তলায় সবার গোডাউন। আগুনের খবর শুনে আমি মার্কেটে আসি। কিন্তু মার্কেটের গেট বন্ধ থাকায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। তাই ভেতরে ঢুকতে পারিনি। নগদ ৩ লাখ টাকা ছিল দোকানে। আর দোকান ও গোডাউনে প্রায় ৩০ লাখ টাকার পোশাক ছিল। সব পুড়ে শেষ।’

বঙ্গবাজারের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হাজি শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘কয়েক হাজার দোকান ছিল। এখন সব ছাই। আর কিছুই নেই।’

এক দিনে সব শেষ
বঙ্গবাজারের পুড়ে যাওয়া কাপড়ের স্তূপে দাঁড়িয়ে আগুনের দৃশ্য দেখছিলেন মাহফুজ ও সেলিনা দম্পতি। মাহফুজ জানান, পোড়া মার্কেটে আনোয়ারা গার্মেন্টস নামে তাঁর একটি গেঞ্জির দোকান ছিল। দুই দিন আগেই ঈদের জন্য দোকানে নতুন মাল তুলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাতে ভালো দোকান রেখে গেছি। সকালে এসে দেখি সব পুড়ে ছাই, কিছুই নেই। চারদিকে আগুন আর ধোঁয়া।’

ভোলার লালমোহন উপজেলার ফাহির আহমেদ ২৫ বছর ধরে বঙ্গবাজারে অন্যের দোকানে কাজ করেছেন। এক বছর আগে তিনি নিজেই একটি দোকান দেন। সেখানে থ্রি-কোয়ার্টার, টু-কোয়ার্টার প্যান্ট বিক্রি করতেন। চারজন কর্মচারী আছে। এবার ঈদের আগে বাবার দেওয়া জমি বিক্রি করে দোকানে মাল তুলেছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফাহির বলেন, ‘ভাই, সব শেষ। আমার কিছুই রইল না।’

ঈদের আগে এমন আগুনের ঘটনায় দোকানমালিক ও মহাজনদের মাথায় হাত। অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও মহাজন বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। অধিকাংশ ব্যবসায়ী দোকানদার মহাজনদের কাছ থেকে বাকিতে মাল এনে বিক্রি করার পর টাকা দেন ৷ কাজল আকতার ময়না নামে একজন মহাজন বলেন, কামরাঙ্গীরচরে ছোট্ট এমব্রয়ডারির কারখানায় নারীদের ওয়ান-পিস তৈরি করেন। বঙ্গবাজারের ৩৫টি দোকানে বাকিতে মালামাল দেন তিনি। ঈদ সামনে রেখে বাড়ির দলিল জমা দিয়ে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন। সব মিলিয়ে তাঁর ১ কোটি টাকা পড়ে আছে এসব মার্কেটের দোকানে।

ঈদ উপলক্ষে নানাভাবে ঋণ নিয়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকায় দোকানে বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের জিনস প্যান্ট তুলেছিলেন তসলিম। এগুলোর সঙ্গে আগুনে পুড়েছে দোকানের ক্যাশে রাখা নগদ টাকাও। সারা জীবনের সঞ্চয় চোখের সামনে দাউ দাউ করে পুড়তে দেখে তসলিমের চোখ গড়িয়ে পড়ছিল পানি। সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘’৭৬ সাল থেকে ছোটখাটো ব্যবসা কইরা এই পর্যন্ত আসছিলাম। ’৯০ সাল থেকে ব্যবসা কইরা এই পর্যন্ত আমি চাইরটা দোকান বানাইছি। এক দিনে আমার সব শেষ হইয়া গেল।’ 

নাশকতার অভিযোগ
দোকানমালিকদের অভিযোগ, এটি নাশকতা। দোকান মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক বি এম হাবিব বলেন, জমি ফাঁকা করার জন্য নাশকতা হতে পারে। দীর্ঘদিন একটি মহল অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিল।

তবে এটিকে দুর্ঘটনা বলেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, ‘এটা দুর্ঘটনা, কোনো নাশকতা নয়। দুর্ঘটনা হওয়ায় এখানে কারও দায় নেই।’

উৎসাহীদের ভিড়ে আগুন নেভাতে বাধা
সকাল ৬টার আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে দুপুর ১২টায়। বিলম্বের অভিযোগ তুলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওপর হামলা চালায় ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও উৎসুক মানুষ। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও বিমান ও সেনাবাহিনী সহযোগিতা করেছে। হেলিকপ্টারে করে হাতিরঝিল থেকে আনা হয় পানি। নেভানোর কাজে যোগ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট।

তারপরও আগুন নেভাতে এত দেরি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উৎসুক জনতা, বাতাস ও পানির সংকটের কারণে আগুন নেভাতে দেরি হয়েছে। বাতাসের কারণে এক দিকের আগুন অন্য দিকে ছড়িয়ে গেছে।’ 
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘আমরা ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করেছি। আমাদের পুলিশ সদর দপ্তরের ব্যারাকেও আগুন ছড়িয়েছে। ব্যারাক পুড়েছে। তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’

অগ্নিকাণ্ডের সময় ব্যবসায়ীরা দোকান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালপত্র বের করে সড়কে রাখলে একশ্রেণির অসাধু লোক তা চুরি করেছে। অনেকের পকেট থেকে মোবাইল ফোনও নিয়েছে। সালাম নামে এক ব্যবসায়ীর মালপত্র ভ্যানসহ নিয়ে পালিয়েছে। তিনি আর ফিরে পাননি।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বঙ্গবাজারের আগুনের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত