Ajker Patrika

কারাগারে থেকেও যশোর নাচাচ্ছেন ‘ফিঙে লিটন’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
Thumbnail image

যশোরে অস্ত্র, হত্যা, চাঁদাবাজিসহ ২০টির মতো মামলার আসামি ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ আনিসুর রহমান লিটন ওরফে ফিঙে লিটন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় প্রায় ২৫ বছর আগে বিদেশে পালিয়ে যান তিনি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।

তবে সন্ত্রাসী লিটনের জন্য কারাগারও যেন নিরাপদ আয়েশি জীবনযাপনের মাধ্যম। রোগী সেজে যশোর কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালে থাকছেন তিনি। ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হয়েও সাধারণ পোশাক পরে থাকেন বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। এমনকি কারা হাসপাতালে বসেই যশোরের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।

কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কারা হাসপাতালে ভিআইপি সেবা দেওয়া হচ্ছে কয়েদি আনিসুর রহমান লিটনকে। উচ্চ রক্তচাপের কথা জানিয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি যশোর কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালের দোতলার ভৈরব কক্ষে রয়েছেন।

ওই কক্ষে অন্য সব রোগীর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। সেখানে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছেন যশোরের সব সিন্ডিকেট। কারাগারের মোবাইল ফোনেই কথা বলছেন বাইরে।’ ওই কারা কর্মকর্তা জানান, কারাগারে শীর্ষ এই সন্ত্রাসীর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করছেন জেলার অনেক নামিদামী ব্যক্তি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার শরিফুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় যেভাবে পড়েছি লিটন সম্পর্কে; কারাগারে তেমনটি দেখছি না। অনেকটা স্বাভাবিক-শান্ত স্বভাবের মানুষ তিনি। কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করছেন না। আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর দুদিন পর থেকে এ পর্যন্ত তিনি কারা হাসপাতালেই আছেন। সেখানে কারা চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রয়েছেন তিনি। সেখানেই তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী তাঁর দর্শনার্থীরাও দেখা করছেন, তাঁর সঙ্গে যাঁরা মোবাইল ফোনে কথা বলছেন, তাও লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।’

তবে জেলার শরিফুল আলম বলেন, কারা হাসপাতালে অসুস্থ বন্দীদের ভর্তি রাখার এখতিয়ার শুধু চিকিৎসকের। কোন বন্দী হাসপাতালে থাকবে, কোন বন্দী থাকবে না, সে সিদ্ধান্ত কারা কর্তৃপক্ষ নেয় না; চিকিৎসকেরা নেন।

যশোর কারা হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা ডা. মাহবুব প্রশিক্ষণে থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে যশোরের সিভিল সার্জন মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘কোনো বন্দী যদি কারা অভ্যন্তরীণে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁকে কারা হাসপাতাল ভর্তি করতে পারেন। তবে আনিসুর রহমান লিটনকে এত দিন কেন রাখা হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’ বিষয়টি সম্পর্কে আমি খোঁজ নেব।’ 

ভিআইপি কায়দায় আত্মসমর্পণ
আদালত ও কারাগারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ফিঙে লিটন অস্ত্র মামলায় আত্মসমর্পণ করার জন্য ৪ সেপ্টেম্বর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে কালো একটি মাইক্রোবাসে আদালতে আসেন। যশোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফারজানা ইয়াসমিনের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিচারক তাঁকে কারাগারে পাঠান। এরপর দ্রুত তাঁকে সেই কালো মাইক্রোবাসে করেই কারাগারে পৌঁছানো হয়। প্রিজন ভ্যান ছাড়া কারাগারে পৌঁচ্ছানো, দ্রুত আদালতে আত্মসমর্পণ ও কারাগারের রাজকীয় জীবনযাপন—সবই করেছেন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। 

কারাগারে বসেই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ
যশোর শহরের বারান্দি মোল্লাপাড়ার বদর উদ্দিনের ছেলে লিটন। ১৯৯৯ সালে অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও গ্রহণ করেছেন নেপালি পাসপোর্ট।

স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকলেও লিটন আধিপত্য বজায় রেখেছেন শহরের মোল্লাপাড়া, বারান্দিপাড়া ও মণিহার এলাকায়। নিজে একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও ২০০৯ সালের পর শেখ হাসিনার সরকারের আমলে পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় করেছিলেন। ২০২১ সালে যশোর পৌরসভা নির্বাচনে ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ফিঙে লিটনের ভাই সাইদুর রহমান রিপন ওরফে ডিম রিপন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন ফিঙে লিটনের স্ত্রী সদর উপজেলা যুব মহিলা লীগের সাবেক আহ্বায়ক ফাতেমা আনোয়ার। নির্বাচনের আগে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তাঁকে যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ফিঙে লিটন দেশের বাইরে থাকলেও দেশে লিটন ট্রাভেলস নামে পরিবহন ব্যবসা রয়েছে।

মণিহার এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, আগে বিদেশ থেকে লিটনের অনুসারীরা ব্যবসায়ীদের কাছে স্কাইপের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ওই সন্ত্রাসীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিত। এরপর ওই ব্যবসায়ীর ওপর ধার্য করা চাঁদার পরিমাণ জানিয়ে দিতেন। দাবি করা চাঁদা না দিলে তাঁর ওপর চালানো হয় নানা নির্যাতন। এখন কারাগার থেকেই এ কাজ করছেন লিটন।

যশোর কারাগার থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া এক আসামি নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে জানান, ‘দেশে না থেকেও যশোর চালিয়েছেন ফিঙে লিটন। এখন তো তিনি যশোরেই। তাঁর কাছে কারাগার কিছুই না। তাঁর নামেই চলে কারাগার। কারা হাসপাতালে থাকছেন রাজকীয়ভাবে। যখন যা খেতে চাইছেন, কারা কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে বাইরে থেকে আনিয়ে খাওয়াচ্ছে।’

যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রাজ্জাক বলেন, কোতোয়ালি থানায় লিটনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। সব মামলার তথ্য আপডেট নেই। কারণ এসব মামলা ২০ বছর আগের। তখন সবকিছু ম্যানুয়াল ছিল। এ জন্য পুরোনো সব মামলার তথ্য আপডেট করা নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত