Ajker Patrika

হারিয়ে যাওয়া একুশের প্রভাতফেরি ও সংকলন

মো. গোলাম রহমান
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২: ২৪
Thumbnail image

স্মৃতিরা তাড়িয়ে বেড়ায়।

ভাষার মাসে স্মৃতিরা আমাদের নিয়ে যায় ঘুমজাগানিয়া প্রভাতফেরির মিছিলে। মফস্বল শহরের সেই স্মৃতিময় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’। ভোরবেলা নগ্ন পায়ে সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে উদাত্ত গলায় গান গেয়ে ঘুম ভাঙানো। ছাত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের কী এক উত্তেজনা! আমরাও এর জন্য কয়েক দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতাম। শিল্পীদের মহড়ার জন্য আনা-নেওয়া, মহড়ায় অংশ নেওয়া–এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকা। শুধু প্রভাতফেরির গান নয়, শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে আরও কিছু কর্মসূচি থাকত। আলোচনা সভা, কখনো কখনো র‍্যালি, শহীদ স্মরণে গীতি-আলেখ্য, শিশুদের চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি। আর প্রভাতফেরিতে শিল্পীরা কাঁধে ঝুলিয়ে বা ঘোড়ার গাড়িতে কিংবা রিকশায় রেখে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুর তুলতেন। সামনে থাকত কালো কাপড়ের ওপর সাদা হরফে লেখা ব্যানার। বুকে কালো কাপড়ের ব্যাজ পিন বা সেফটিপিন দিয়ে শার্ট, পাঞ্জাবি কিংবা শাড়িতে সেঁটে দেওয়া হতো। কারও কারও হাতে ধরা থাকত ফেস্টুন বা প্ল্যাকার্ড। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রভাতফেরিতে এসে যোগ দিত, ধীরে ধীরে মিছিল বড় হয়ে উঠত। সবাই সমস্বরে গাইত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’। নগরের লোকজন জেগে উঠত, নিজেদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শুনত সেই উদাত্ত কণ্ঠের গানের সুর, সেই গানের সুর শুনে আবেগ মথিত কারও কারও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। ছাত্রসংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো সাংবাৎসরিক এই সব কাজের জন্য ছিল নিবেদিত। পাড়ায় পাড়ায়, এলাকায় এলাকায় এই সব তৎপরতা এখন হয়তো কমে গেছে, কোথাও কোথাও এগুলো বিলুপ্তপ্রায়। কোথায় হারিয়ে গেল সেই প্রভাতফেরি!

শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার জন্য একটা সময় ছিল বিভিন্ন জনের বাড়ির আঙিনায় ফুলের বাগান থেকে ফুল সংগ্রহের প্রচলন; বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে অনেকেই শহীদ দিবসের আগের রাতে ফুল সংগ্রহ করত। কেউ কেউ উৎসাহ ভরে বাগান থেকে ছেলেমেয়েদের ফুল দিতেন শহীদ মিনারে দেওয়ার জন্য। আবার কোনো কোনো বাগানের মালিক ফুল না দেওয়ার জন্য রাতভর পাহারা বসাতেন। সেকালে তো ফুল আজকের দিনের মতো দোকানে বিক্রি হতো না। নিজেদের বাড়ির আঙিনা কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাগান থেকে সংগ্রহ করে ব্যক্তি উদ্যোগে ফুল দেওয়ার বড় রকমের প্রচলন ছিল। বাগানের মালিরা কারও কারও জন্য ফুলের স্তবক কিংবা ফুল দিয়ে চক্রাকার ডালি সাজাতেন। তার মাঝে লেখা থাকত ‘শহীদ স্মরণে’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’, ‘শহীদ স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘ভাষাশহীদদের অমর স্মৃতিতে...’ ইত্যাদি। ছাত্র-জনতা, বিভিন্ন পেশার নারী-পুরুষ ও সাধারণ মানুষ হাতে কয়েকটি ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে নগ্ন পায়ে ভাবগম্ভীর পরিবেশে উপস্থিত হতো শহীদদের স্মৃতিতে প্রাণের অর্ঘ্য নিবেদন করতে। আজও এই ধারা বজায় আছে। তবে ফুলের বৈচিত্র্য, দেশি-বিদেশি ফুলের সমাহার বেড়েছে আজকের বাজার-সংস্কৃতির বদৌলতে। আগে বাগান থেকে পাওয়া যেত গোলাপ, গাঁদা, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা ইত্যাদি এবং বাড়িঘরের আশপাশ থেকে মিলত শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রক্তকরবী–এসব ফুল।

একুশের সংকলন বলে আমরা প্রথমেই যা বুঝি তা হলো, একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের স্মরণে প্রকাশিত সাহিত্য সংকলন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, সেই শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু রাখার প্রতিশ্রুতিতে প্রকাশিত হয় সাহিত্য সংকলন। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম সংকলন, যার সম্পাদনার কাজটি করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। এই সংকলনে স্থান পেয়েছিল একুশের প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, গান, ইতিহাস ইত্যাদি। এটির প্রকাশক ছিলেন ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান। এই সংকলনের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমিনুল ইসলাম আর রেখাচিত্র এঁকেছিলেন মুর্তজা বশীর। এই ধারায় সারা দেশেই সাহিত্য সংকলন বের হওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়।

১৯৬০ ও ৭০-এর দশকের কথা মনে করতে পারি সহজেই। আমার মনে পড়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সময়টা ছিল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তরুণসমাজ তখন বেশ তৎপর ছিল। ষাটের দশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি সারা দেশকে তোলপাড় করে তুলত। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পুরো দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তরুণসমাজ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এদিকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসতেই এই তরুণেরা উদ্দীপ্ত হতো। ছাত্রসংগঠন, সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে একুশে উপলক্ষে সাহিত্য সংকলন বের করার প্রচেষ্টা ছিল। সাহিত্যামোদী তরুণেরা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিত এবং ব্যক্তিগতভাবে লেখা জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। এসব প্রকাশনার ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ সংস্থান করাও ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। মফস্বল শহরে এই বিষয়গুলোয় ছিল আরও বড় প্রতিবন্ধকতা। এসব মোকাবিলা করে, শেষ পর্যন্ত লেখা জোগাড় করে তাড়াহুড়োর মধ্যে যে কাজটি চলে তা হলো, প্রেসের কাজ। প্রেসে লেখা কম্পোজের সঙ্গে সঙ্গে প্রুফ রিডিংয়ের তৎপরতা চলে অবিশ্বাস্য গতিতে। সে সঙ্গে প্রচ্ছদের কাজ। প্রচ্ছদ আঁকাজোকার কাজ করেন স্বনামধন্য শিল্পীরা। তাঁদের কাছ থেকে প্রচ্ছদের ডিজাইন এবং ভেতরকার অলংকরণের কাজ শেষ হলে চলে ব্লক তৈরির পালা। মুদ্রণের কাজ শেষ হতো ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। যাঁরা লেখা দিতেন, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, সেই প্রকাশিত লেখা নিজের চোখে দেখার আগ্রহ এবং উৎসাহ থাকত যারপরনাই। এই প্রকাশনাগুলোর বেশির ভাগ বিনা মূল্যে বিলি করা হতো যার যার প্রিয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে। কারও কারও কাছ থেকে দুই-চার টাকা বিনিময় হিসেবে নেওয়া হতো। আমার যত দূর মনে পড়ে, অনেক তরুণ লেখক এই সব সংকলনে লেখা প্রকাশ করে পরবর্তী সময়ে উল্লেখযোগ্য লেখক হয়ে উঠেছেন। মফস্বল থেকে উঠে আসা অনেকে একুশের সংকলনে লেখা ছাপিয়ে লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ নিয়েছেন। তবে নতুন লেখকদের ঝোঁক থাকত কয়েকজন বিখ্যাত লেখকের লেখা পাওয়ার জন্য যেন তাঁদের লেখার পাশাপাশি নতুনদের লেখা ছাপা হয়, তাতে তাঁদের লেখা মানসম্পন্ন বলে মনে হবে এবং তাঁদের লেখক পরিচিতি পোক্ত হবে। বড় বড় সংস্থা ও সংগঠনের পক্ষ থেকে যে স্মরণিকা বের হতো, সেগুলো বেশির ভাগ স্বনামধন্যদের লেখা-সমৃদ্ধ হয়ে বের হতো। এই সব প্রকাশনার ব্যাপক জনপ্রিয়তা লক্ষ করা যায়। অনেকে একুশের সংকলন সংগ্রহ করে রাখতেন। আমি নিজে একসময় এই সব সংকলন সংগ্রহ করতাম আগ্রহভরে।

লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে নতুন লেখক সৃষ্টির একটি প্রবণতা আমরা আগেও লক্ষ করেছি। একুশের প্রকাশনা এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে প্রতীয়মান হয়। পাশ্চাত্যের ভাবধারায় বঙ্গদেশে লিটল ম্যাগাজিন প্রবর্তন করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী বহুকাল আগে, সম্ভবত ১৯১৪ সালে সবুজপত্র প্রকাশনার মাধ্যমে। সেই ট্র্যাডিশন চালু আছে দীর্ঘকাল। বাংলাদেশে মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও সুচরিতা চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘চট্টগ্রাম’ প্রকাশিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এই ম্যাগাজিনের কথা স্মরণীয় হয়ে আছে। ষাটের দশকেও এই ধারা যেভাবে সাহিত্য আন্দোলনে শক্তি জুগিয়েছে, সত্তরের দশকে তার রেশ কিছুটা কমলেও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ চলে আসে এবং একটা সময় সাপ্তাহিক-পাক্ষিক পত্রিকাগুলো লিটল ম্যাগাজিনের জায়গাটা কবজা করে ফেলে।

আজও একুশের সংকলনের জন্য মন কাঁদে। মনে হয় একুশের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এর চেয়ে বড় আর কী আছে? সামাজিক মাধ্যমের এই যুগে নতুন করে ই-সাহিত্য একুশের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখবে—অন্তত সেই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

মো. গোলাম রহমান
সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত