Ajker Patrika

দুর্গোৎসব ও মূর্তি ভাঙচুর

সম্পাদকীয়
দুর্গোৎসব ও মূর্তি ভাঙচুর

এ মাসেই শারদীয় দুর্গোৎসব। প্রতিবছরই সনাতন ধর্মাবলম্বীর মানুষ যথাযথ মর্যাদায় উৎসবটি পালন করে থাকে। প্রতিবছরই দেশের কোথাও না কোথাও মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। অথচ সমবেতভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিরোধের উদ্যোগ নিলে এই ভাঙচুর হওয়ার কথা নয়।

দেশের সব মুসলমান নিশ্চয়ই একযোগে মূর্তি ভাঙার প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে সামাজিক সৌহার্দ্য নেই—এ কথাও বলা যাবে না। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষও উচ্চ পদে আসীন দেখা যায়। তাঁরা যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গেই তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ফলে দেশব্যাপী ভিন্ন ধর্মের প্রতি মুসলমান সম্প্রদায় অসহিষ্ণু, এমন কথা বলা যাবে না। একশ্রেণির দুর্বৃত্ত কিছু বদ লোকের মদদে এই বদমায়েশি করে থাকে। কখনো কখনো সমাজের সচেতন মানুষের প্রতিরোধে এই দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়, কখনো অন্য কারও পৃষ্ঠপোষকতায় এরা ভাঙচুরের কাজ সমাধা করে লুকিয়ে পড়ে।

বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় পাশাপাশি বসবাস করে এসেছে। কৌম সমাজে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও চলত। যখন বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা শুরু হলো, তখনো গরিব হিন্দু আর গরিব মুসলমানের জীবনযাত্রায় বিদ্বেষ দেখা গেছে কম।

ইতিহাস বলে, মূলত শাসকগোষ্ঠীই দরিদ্র মানুষের ওপর অত্যাচার চালাত। আর এ কথা তো ঠিক, কর্ণাট থেকে আসা সেন রাজাদের বাংলা শাসনের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, মোগল প্রশাসনে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। ফারসি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের বিত্তবান মানুষ এবং মোগলদের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

ইতিহাসের এই পর্যায়ে ধনী হিন্দু-মুসলমান শাসন করেছেন দরিদ্র হিন্দু-মুসলমানদের। ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকেও প্রশাসনে অগ্রাধিকার পেয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। শিক্ষিত হিন্দু সমাজে জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয় হলে ব্রিটিশরা ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতি নিয়েছে। হিন্দু ও মুসলমানের মনে বড় আকারে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ জেগে উঠেছিল মূলত রাজনৈতিক কারণে; বিশেষ করে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় এই বিদ্বেষ প্রকট হয়ে ওঠে। এর পর থেকে অখণ্ড ভারতে কিংবা পরবর্তীকালে বিভক্ত ভারতবর্ষে ধর্মীয় সম্প্রীতি পোক্তভাবে আর জায়গা করে নিতে পারেনি।

সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের কারও মনে বড় আকারে ধর্মবিদ্বেষ ছিল না। কিন্তু সেটাই ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই কেবল এই বিদ্বেষকে জিইয়ে রেখেছে, তা নয়; রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের স্বার্থে এই বিদ্বেষের পৃষ্ঠপোষক হয়েছে। সত্যিকারের শিক্ষা এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারত, কিন্তু সেটা হয়নি।

শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় সম্মিলিতভাবে পূজামণ্ডপ রক্ষার ভার নিতে হবে। আমরা যে অসাম্প্রদায়িক, প্রত্যেকে তার নিজের ধর্ম এখানে ঠিকভাবে পালন করতে পারে, সেটা যেন শুধু কথার কথা হয়ে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে পারলেই সম্প্রীতির পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত