Ajker Patrika

সংখ্যার জাদুকর

রজত কান্তি রায়
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০: ১৯
সংখ্যার জাদুকর

পিথাগোরাস সংখ্যা নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন। তিনি মনে করতেন, পৃথিবীর সব বস্তুর ব্যাখ্যা করা সম্ভব একক সংখ্যা দিয়ে। জ্যোতিষশাস্ত্রে সংখ্যার গুরুত্ব অনেক। সেই শাস্ত্রমতে, সংখ্যা পদ্ধতি গণনা করে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, সেটা সংখ্যাতত্ত্ব বা নিউমারলজি। কাওসার আহমেদ চৌধুরী এই সংখ্যাতাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, মানুষ সেটা পড়ত। কারণ তিনি ‘রাশিফল’ বিষয়টিকে সুস্বাদু পড়ার বিষয় করে তুলেছিলেন। খুব সম্ভবত সংখ্যা বিষয়টির যে রহস্যময়তা, তা কাওসার আহমেদ চৌধুরীর জীবনে ছিল ইনবিল্ট।

বাংলাদেশ স্বাধীন হতে তখনো ঢের বাকি। কিংবা এভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছে, তখন কাওসার আহমেদ চৌধুরী সাতাশ বছরের টগবগে যুবক। সে জন্যই হয়তো মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সাহস করেছিলেন। খেয়াল করলে দেখবেন, তাঁর জন্ম হয়েছিল সিলেটে ১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এভাবেই কি তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন জন্মের সূত্র ধরে? অপার রহস্যই বটে। ১৬ ডিসেম্বর তারিখটি আমাদের বিজয়ের তারিখ। ১৪ বা ১৫ কিংবা ১৭ ডিসেম্বর হতে পারত তাঁর জন্মতারিখ। কিন্তু না, একেবারে ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ঠিক ২৭ বছর আগে যখন বাংলাদেশের জন্মই হয়নি, দেশভাগ হয়নি, সেই সময় ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ জন্মেছিলেন তিনি। রহস্য না বলে পারা যায়? আবার ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার বিজয় আনার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন।

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর জন্মতারিখ ১৬। এর একক হলো ১+৬ =৭। এই ৭ সংখ্যাটি বিভিন্ন অর্থে অদ্ভুত নিউমারলজিতে। ৭ লাকি বা সৌভাগ্যের সংখ্যা। এই সংখ্যার মানুষদের বৈশিষ্ট্য একটু অন্য রকম। যেমন তাঁদের বন্ধুভাগ্য ভালো, জীবনে ভীষণ উত্থান-পতন থাকে এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাঁদের, তাঁরা অর্থের চেয়ে আত্মিক উন্নতি করে থাকেন ভীষণভাবে। এই আত্মিক উন্নতি হতে পারে বিভিন্ন ধারায়। তাঁদের কল্পনা শক্তি অন্য অনেকের চেয়ে উন্নতমানের। এই রাশির মানুষেরা প্রাচীনপন্থী হলেও মননে বৈপ্লবিক এবং আধুনিক। যাঁরা কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা এ বিষয়গুলোর খোঁজ করতে পারেন। আমরা যারা তাঁর ভক্ত-অনুরক্ত, তারা বাইরের কিছু খোঁজখবর করি।

বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে মানুষের জীবন বর্ণাঢ্য হয় না। এই উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহের যুগে উন্মুক্ত তথ্য হিসেবে যতটুকু জানা যায়, কাওসার আহমেদ চৌধুরী ১১ বছর বয়সে জ্যোতিষচর্চা শুরু করেছিলেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর গান লেখার শুরু। সরকারি চাকরি করেছিলেন কিছুদিন। তারপর গান লেখা ও জ্যোতিষশাস্ত্রকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যাঁর অভিজ্ঞতা ও কল্পনাশক্তি যত প্রখর ও উন্নত, অর্থকেই জীবনের এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে যাঁরা ভাবেন না, এসব পেশায় তাঁরাই সফল হন। সব বাদ দিন। একবার শুধু ভাবুন আইয়ুব বাচ্চু মঞ্চে উঠে হাজার হাজার মানুষকে উদ্বেলিত করে চলেছেন ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’ গেয়ে। কিংবা ধরুন মঞ্চে মন্ময় হয়ে ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’ গাইছেন এখনকার কোনো নবীন গায়ক, আর আপনি গুগল ঘেঁটে জানছেন এই গানগুলো লিখেছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী নামের এক খ্যাপাটে মানুষ। আপনার কী মনে হবে? আবার হালের ফিউশনে ‍কুমার বিশ্বজিতের নিজেরই গাওয়া ‘যেখানেই সীমান্ত তোমার সেখানেই বসন্ত আমার’ শুনে বিরক্ত হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবেন ‘আগের কম্পোজিশনটাই ভালো ছিল’ তখন বুঝতে হবে, আপনি কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কথাই শুনছেন। ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়ল’, ‘মৌসুমি কারে ভালোবাসো তুমি’ এসবই যখন শুনছেন, তখন আসলে আপনি এক পাগলাটে স্বপ্নবান অমিত মেধাবী মানুষের কথাই শুনছেন, যাঁকে আমরা সম্মান করিনি, সম্মানিত করিনি।

এত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও, গুরুত্বপূর্ণ গান লেখাসহ আরও অনেক কাজকর্ম করার পরেও এই যে তাঁর সম্মান না পাওয়া, এটাও কিন্তু সংখ্যা ৭-এর খেলা। ওই যে, অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এই রাশির মানুষদের।

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর পুরো জন্ম সাল, মাস ও দিনের যোগফল (১ +৯ +৪ +৪ +১ +৬ +১ +২) = ২৮। আবার ২ +৮ = ১০। নিউমারলজিতে এই ১০ সংখ্যাটিকে ম্যাজিক্যাল নম্বর বলা হয়। চৌধুরী সাহেবের জীবন কি ম্যাজিক্যাল নয় বলে ভাবছেন? যাঁরা খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন, তাঁরা যদি আমাদের তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও কিছু তথ্য দেন, আমরা আরও একটু খতিয়ে দেখব তাঁর জীবনে কতটা জাদুময়তা ছিল। তিনি যে যথেষ্ট জাদুকরী জীবন কাটিয়েছেন সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর শেষ ম্যাজিক কী? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, সেটাও সংখ্যারই জাদু-২। ২০২২ সালের দ্বিতীয় মাসের ২২ তারিখে মারা যান তিনি। সংখ্যায় ২০২২.২২. ০২ এভাবে লেখা যায়। আগামী এক শ বছর এই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবে না। এই সবগুলো ২ যোগ করলে (২ +০ +২ +২ +২ +২ +২) হয় ১২। এই সংখ্যাটির যোগফল (১ +২) হয় ৩। এই সংখ্যার মানুষদের জীবন হয় আনন্দমুখর। এই ৩ সংখ্যাটির সঙ্গে যদি তাঁর ১০০ বছরের রেকর্ড যোগ করেন, তার যোগফল হবে ৪। অর্থাৎ ৩ +১ +০ +০ =৪। এ সংখ্যার মানুষেরা ভীষণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের কর্ম ও গুণের জন্য তিনি বরেণ্য হয়ে ওঠেন। কারণ, মানুষ তাঁর সঙ্গে অন্যদের তুলনা করতে শুরু করেন। যেসব তুলনা আসতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম দুটো হলো,

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর মতো গান লিখতে পারা একটা বিষয় বটে।

কাওসার আহমেদ চৌধুরীর মতো সুখপাঠ্য রাশিফল আর কেউ লিখতে পারবেন কি?

রাশিফল বা সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাস করবেন কি না, সেটা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু সংখ্যার যোগফলে অনন্য হয়ে ওঠা মানুষ হিসেবে কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে আমরা ভালোবেসে যাব।

রজত কান্তি রায়: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত