Ajker Patrika

বিদায় মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী

জাহীদ রেজা নূর
বিদায় মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী

২৭ মার্চ অফিস থেকে ফিরছি, এ সময় অজানা নম্বর থেকে একটা ফোনকল এল। রিসিভ করতেই ও প্রান্ত থেকে নূরে আলম সিদ্দিকীর কণ্ঠ, ‘আব্বু, তোমার ফোন নম্বর পেয়ে গেছি। এবার থেকে কিন্তু আমি নিজেই ফোন করব।’

নূরে আলম কাকার বেশ কয়েকটি ফোন। তাঁর দুটির নম্বর আমার কাছে আছে। বাকিগুলোর নেই। সেই ‘নেই’ নম্বরের একটি থেকেই ফোনটা এসেছে। তাঁর সচিব অনিকেত রাজেশের কাছ থেকে আমার নম্বরটি নিয়েছেন।

বিগত কয়েক মাসে অনেকবার তাঁর কাছে গিয়েছি। যে আত্মজীবনীটি লিখছিলেন, সেটার কোথাও তথ্য ভরাট করার দরকার থাকলে সে বিষয়ে তাঁর কাছে জেনে নিয়েছি। এভাবেই বইটি প্রায় প্রস্তুত হয়ে গেছে। সেই ২০১২-১৩ সালের দিকে আমার অগ্রজ শাহীন রেজা নূর তাঁর কাছ থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনটা সম্পর্কে জেনে নিচ্ছিলেন। আত্মস্মৃতি প্রকাশ করার প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু এরই মধ্যে শাহীন ভাই নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং মারা গেলেন। ফলে নতুন করে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। সে কারণেই ছক কেটে তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ এবং বইটিকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।

তিনি বললেন, ‘এত দিন তো তুমি ফোন করেছ, এবার থেকে আমিও তোমাকে ফোন করব। বইয়ের জন্য আর কিছু কি লাগবে?’

বললাম, ‘বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্বটায় কোনো কোনো ঘটনা সম্পর্কে আপনার আরও কিছু মন্তব্য থাকলে ভালো হতো।

এর মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে আপনাকে বলেওছিলাম। আপনি বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো না থাকলে ধারাবাহিকতায় সমস্যা হয়।’ 

‘ঠিক আছে, বলব। কাল ফোন কোরো আব্বু। তিনটার পর ঘুম থেকে উঠে যাব।’

২৮ মার্চ আমার প্রশ্নগুলো ঠিক করে তাঁকে ফোন করলাম। কিন্তু তিনটি ফোনের কোনোটাতেই কোনো সাড়া পেলাম না। ভাবলাম, ঠিক আছে, পরেও তো কথা 
হতে পারে।

২৭ মার্চ করা ফোনটাই যে নূরে আলম কাকার শেষ ফোন হবে, সেটা বুঝতে পারিনি তখন। আজ লিখতে বসে মনটা বেদনায় আকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সকালে তাঁর প্রাণহীন দেহটা দেখে হু হু করে উঠল মন। 

২. ছাত্রলীগের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারায় যে রাজনীতি এগিয়েছিল, তারই একজন প্রবক্তা ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির যে পথটি নির্মিত হয়েছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে, যে ধারাটিকে লেখনীর মাধ্যমে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও সিরাজুদ্দীন হোসেন, সে পথেই এগিয়েছেন নূরে আলম সিদ্দিকী।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের সময় তিনি বড় নেতা নন, কিন্তু ঐতিহাসিক ৭ জুন তাঁকে প্রথম সারির নেতা হিসেবে তৈরি করে। তেজগাঁও এলাকায় হরতালের সময় পুলিশের গুলিতে তাঁরই হাতে ঢলে পড়েছিলেন মনু মিয়া। মনু মিয়ার রক্তাক্ত জামা নিয়ে মিছিল করেছিলেন তিনি। এর কিছুদিন পর গ্রেপ্তার হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে অনেকবার রয়েছে নূরে আলম সিদ্দিকীর প্রসঙ্গ।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর জেল থেকে বের হন তিনি। এর আগেই জ্বালাময়ী ভাষণ রপ্ত করেছিলেন। তাঁর ভাষণ ছিল সাহিত্যরসে ভরপুর এবং রাজনৈতিক তেজদীপ্ততায় ঋজু। সে সময় যাঁরা নূরে আলম সিদ্দিকীর ভাষণ শুনেছেন, তাঁরা এক প্রবল উন্মাদনা নিয়ে বাড়িতে ফিরতেন, তাঁদের মনে থেকে যেত সেই ধ্রুপদি ভাষণের রেশ।

১৯৭০ সালে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু সে সময় ছাত্রলীগের কমিটিতে সমাজতন্ত্রপন্থী গ্রুপটা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের চাপে কীভাবে জাতীয়তাবাদী ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সেই নীতিনির্ধারণে সঙ্গে পেয়েছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের কাউকে কাউকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের এই দুটি ধারার কোনোটিকেই অগ্রাহ্য করতেন না। তাঁর আশীর্বাদ পেয়েছিল দুটি ধারাই। তবে সমাজতন্ত্রী ধারা যখন নির্বাচনের মাধ্যমে ম্যান্ডেট পাওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করল, নির্বাচন ব্যতিরেকেই স্বাধিকার আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাইল, তখন জাতীয়তাবাদী ধারার পক্ষে নূরে আলম সিদ্দিকী অসাধ্যসাধন করেছিলেন। পল্টনের জনসভায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ম্যান্ডেটই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা দিয়েছিল, সে কথা নতুন করে বলার নয় এবং নূরে আলম সিদ্দিকী ও ছাত্রলীগকে সে সময় দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন, এ কথা তিনি অকপটে স্বীকার করতেন।  
 
৩. নূরে আলম সিদ্দিকীর আরেকটি বড় কীর্তি হলো, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া যখন অধিবেশন স্থগিত করে দিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সমর্থন নিয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা। এই সংগ্রাম পরিষদটি গঠিত হয়েছিল শুধুই ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়ে। এর আগপর্যন্ত যত আন্দোলন হয়েছে, তাতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এবারই প্রথম ছিল ব্যতিক্রম। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই সংগ্রাম পরিষদের নানা ধরনের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের উপাদানে পরিণত হয়েছে। এখানে বলে রাখা দরকার, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন যে কথাগুলো বলতে পারতেন না, সেগুলো এই ছাত্রনেতাদের দিয়ে বলাতেন।

ঐতিহাসিক সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসার আগে মাঠ গরম রাখার জন্য যাঁরা অবিশ্রান্ত স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেওয়ার আগে যাঁর কণ্ঠস্বর শোনা যায়, সেই কণ্ঠস্বরের মালিক নূরে আলম সিদ্দিকী।

বাকশাল-প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করতে পারেননি নূরে আলম সিদ্দিকী। গণতান্ত্রিক ধারা থেকে বঙ্গবন্ধু সরে যাচ্ছেন, এ রকম ইঙ্গিত দিয়ে তিনি সংসদে দীর্ঘ বক্তৃতাও করেছিলেন। কিন্তু তাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরেনি। আজীবন বঙ্গবন্ধুকে ‘লিডার’ বা ‘বস’ হিসেবেই সম্বোধন করেছেন এবং শ্রদ্ধা করেছেন।
সেই অনিশ্চিত সময়টিতে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, গোপালগঞ্জে শেখ লুৎফর রহমানের নামে যে কলেজটি হয়েছে, আপাতত সেখানে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিতে। নূরে আলম সিদ্দিকী স্থিত হওয়ার জন্য কিছুদিন সময় চেয়েছিলেন।

এরপর তো ঘটে গেল সেই কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রধান সিপাহসালার জেনারেল ওসমানীর স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। দেশে ফেরার পর ছাত্রলীগের বিভক্তি, তারই প্রতিক্রিয়ায় যুবলীগ গঠন (যার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি), বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি যদি পাশাপাশি রেখে দেখা যায়, তাহলে একজন মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক নেতার অবয়বই ভেসে উঠবে। আমার সৌভাগ্য, খুব কাছে থেকে তাঁর জীবনেতিহাস শুনতে পেরেছি।

২৯ মার্চ ভোরে আমি আমার অভিভাবকদের একজনকে হারালাম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিএনসিসির পদ ছাড়লেন এস্তোনিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

পদত্যাগ করব না, আলোচনা করে সমাধান করব: কুয়েট উপাচার্য

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত