Ajker Patrika

নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যা আবার আলোচনায়

সাবিত আল হাসান, নারায়ণগঞ্জ
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬: ০৬
নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যা আবার আলোচনায়

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উত্তর ও দক্ষিণ বলয়ের বিবাদ নতুন কিছু নয়। চুম্বকের দুই মেরুর মতোই একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান। রাজনৈতিক ইস্যু থেকে শুরু করে সামাজিক সমস্যাতেও দেখা যায় তাদের বিপরীতমুখী অবস্থান। এর মধ্যেই তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ড এবং তাঁর পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রাম বেশ বেকায়দায় রেখেছে উত্তর বলয় তথা ওসমান পরিবার ও তাদের অনুসারীদের।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ ত্বকীকে অপহরণ এবং ৮ মার্চ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সেই ঘটনার পর থেকে প্রতি মাসের ৮ তারিখ আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবছরের ৮ মার্চ বৃহৎ পরিসরে কর্মসূচি পালন করে থাকে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ এবং নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট। সেই কর্মসূচিতে জাতীয় পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত হওয়ায় পুরো কর্মসূচির খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

গত ২৮ জানুয়ারি এক মতবিনিময় সভায় শামীম ওসমান বলেন, ‘আগামী কয়েক দিন পরেই দেখবেন কিছু লোক রাস্তায় নামবে। আবার সেই ত্বকী হত্যা নিয়ে কথা বলবেন। আমি ত্বকী হত্যার বিচার চাই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও বলব প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করুন। দ্রুত বিচার করুন। শুধু ত্বকী না, আমি সব হত্যার বিচার চাই।’

৮ ফেব্রুয়ারি এসব কর্মসূচির অংশ হিসেবে চাষাঢ়া শহীদ মিনারে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট। সেখানেও গতানুগতিক ত্বকী হত্যার জন্য প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান, শামীম ওসমান ও অয়ন ওসমানকে দায়ী করে বক্তব্য দেন জোটের নেতারা।

৯ ফেব্রুয়ারি আজমেরী ওসমানের পক্ষে নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে বাংলাদেশ ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। মূলত আজমেরী ওসমানের অনুসারীরাই এই মিছিল পরিচালনা করেছিলেন। মিছিল থেকে রফিউর রাব্বীর দেওয়া বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে এর দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

১০ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলায় নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ফতুল্লার নম পার্কে মতবিনিময় সভা ডাকেন শামীম ওসমান। সেখানে ত্বকী হত্যার ইস্যুতে বলেন, ‘রাস্তার পাশে ১০ জন বক্তব্য দিয়ে আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে উদ্ধার করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যা নিয়ে দোকানদারি করা হচ্ছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তথ্যপ্রমাণসহ যতটুকু আমি জানি তা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করব।’

শামীম ওসমান আরও বলেন, ‘এক খসড়া চার্জশিটের কথা বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা আদৌ আইনে নাই। ওই সময়ে র‍্যাবের কর্মকর্তারা এটা তদন্ত করেছিলেন, তাঁদের প্রধান সাত খুন মামলায় এখন কারাগারে। মেজর আরিফ কার সঙ্গে কথা বলেছিল, কার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেছিল। যদি আগেরটা বেছে নেই তাহলে নারায়ণগঞ্জে কেউ ৫ মিনিটও দাঁড়াতে পারবে না। জনগণই জবাব দেবে।’

১১ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ’ র‍্যাব থেকে প্রেরিত খসড়া চার্জশিট পুনরায় প্রকাশ করে। এদিন পত্রিকার প্রধান শিরোনাম করা হয় ‘যা ছিল খসড়া চার্জশিটে’। মূলত এই খসড়া চার্জশিটটি ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে পাঠানো হয়েছিল।

১২ ফেব্রুয়ারি সেই পত্রিকা অফিসে হামলা চালায় আজমেরী ওসমানের অনুসারীরা। এ সময় অফিসের স্টাফদের লাঞ্ছিতসহ সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করে তারা। পরে ‘যা ছিল খসড়া চার্জশিটে’ প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য ক্ষমা চাইতে বলে এবং তা না করলে সম্পাদককে গুলি করে মেরে অফিসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যায়।

এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘রাব্বী ভাই প্রতি মাসে কর্মসূচি পালন করে আসছে। তাঁরা প্রতি বছরই বড় করে তাদের কর্মসূচি পালন করে। হঠাৎ করে সাংসদ শামীম ওসমান নম পার্কে দুইবার এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করায় বিষয়টি উত্তপ্ত হয়েছে। তিনি এসব বক্তব্য না রাখলে বিষয়গুলো এত দূর গড়াত না। বিশেষ করে পত্রিকা অফিসে হামলার মতো ঘটনাও ঘটত না।’

নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শাহীন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ ৮ বছরের বেশি সময় বিচার চেয়ে আসছি। মার্চ মাসে বড় আকারে কর্মসূচি পালন করি কেবল হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে। আমাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই যে, আমরা সরকারের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করে ফেলব। আমরা একটি দাবিতেই একত্র হই। অপরাধীকে চিহ্নিত করে বক্তব্য রাখলে তিনি উত্তেজিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। এখন কেউ তাঁর কর্মীদের উজ্জীবিত করতে গিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করলে সেই দায় তাঁকেই বহন করতে হবে।’

সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বী বলেন, ‘আমাদের এই বিচার চাওয়া নতুন কিছু নয়। ইতিপূর্বেও শামীম ওসমান বলেছিলেন তিনি সংবাদ সম্মেলন করবেন। এবারও বলছেন সংবাদ সম্মেলন করবেন। আমরা প্যান্ডোরার বাক্সের কথা জানি। তিনি যখন বেকায়দায় পড়েন, তখন তাঁর প্যান্ডোরার বাক্স খুলে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে চান। এবারও তাঁর এই মন্তব্য করা ব্যতিক্রম কোনো নজির নয়।’

হামলার শিকার হওয়া পত্রিকার সম্পাদক জাভেদ আহমেদ জুয়েল বলেন, ‘প্রতি বছর মার্চ মাস ঘিরে উত্তপ্ত হয় নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গন। কারণ এই মাসেই মৃত্যু হয়েছিল মেধাবী কিশোর ত্বকীর। আমরা কেবল সমসাময়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে সেই খসড়া চার্জশিটের লেখাটি হুবহু প্রকাশ করেছিলাম। এটি ইতিপূর্বেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে আমাদের কোনো বক্তব্য ছিল না। নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এই ধরনের উত্তেজনা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু গণমাধ্যম অফিসে হামলার মতো যেই উদ্ধত আচরণ অত্যন্ত ন্যক্কারজনক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...