Ajker Patrika

কিশোর গ্যাং, মাদক: দেখার দায়িত্ব কার?

স্বপ্না রেজা
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২২, ১০: ২৭
কিশোর গ্যাং, মাদক: দেখার দায়িত্ব কার?

সম্প্রতি সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জিতুকে উৎপল কুমার তার আচরণ সংশোধনের জন্য বলেছিলেন এবং স্কুল কমিটিকেও তা অবহিত করেন। জিতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত এবং একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এসবে আপত্তি করায়ই উৎপল কুমারের কাল হয়েছে।

একজন শিক্ষার্থী কখনোই তার শিক্ষককে আঘাত করতে পারে না। সাধারণ জ্ঞান তা বলে না। মা-বাবার পরই হলো শিক্ষকের স্থান। শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার উপযুক্ত শিক্ষা শিক্ষকই দিয়ে থাকেন। কাগজ-কলমে জিতু শিক্ষার্থী হলেও আসলে সে মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল না। প্রশ্ন, এ দায় কার? শুধু শিক্ষকের! স্বীকার করতেই হবে, জিতুদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রশ্রয়ে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। কিশোর গাংয়ের সদস্যরা আধিপত্য বিস্তারে হিরোইজম দেখাতে গিয়ে নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করে অবলীলায়। এদের অনেকেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থী। কিন্তু পড়াশোনার ধারেকাছেও তারা থাকে না। এই তথ্য স্কুল কর্তৃপক্ষের জানা থাকলেও তাদের করার কিছু থাকে না। সেটা ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণে।

সমাজে জিতুদের তৈরি হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ আছে। তবে সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়টি অনেকেই সামনে আনেন। এই সামাজিক অবক্ষয় বিষয়টি কী, কীভাবে তার উত্থান, আগ্রাসন ইত্যাদি সম্পর্কে গভীরে না গিয়ে সামাজিক অবক্ষয় দূর করতে হবে বলেই তাঁরা দায় সারেন। কেউই অপরাধী হিসেবে জন্ম নেয় না। জেনেটিক কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ধীরে ধীরে পরিবেশ থেকে দেখেই সে সবকিছু শেখে, অনুকরণ করে এবং নিজেকেও সেভাবে গড়ে তোলে। মানুষের বুদ্ধি ও জ্ঞানীয় বিকাশ পরিবেশ অনুযায়ী ঘটে। উপযুক্ত পুষ্টিকর খাবার না খেলে যেমন মানবশিশুর শারীরিক বিকাশ সুস্থভাবে ঘটে না, ঠিক তেমনি পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর, শৃঙ্খলা ও শিক্ষণীয় না হলে মানবশিশুর মানসিক বিকাশ সুস্থভাবে ঘটে না। অর্থাৎ সে যা প্রত্যক্ষ করবে সেটাই তার ভেতর জায়গা করে নেবে। সে অনুযায়ী সে আচরণ করতে শিখবে।

শিশুর প্রথম পরিবেশ তার পরিবার। কী দেখে বড় হচ্ছে সে। পরিবারে তার মানসিক সুস্থতার চাহিদা কতটুকু পূরণ হচ্ছে কিংবা মানসিক বিকাশে পরিবার কতটা আন্তরিক বা সক্ষম, বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবাকেই সন্তান প্রথম চিনতে পারে। তাঁদের দেখে আস্তে আস্তে সবকিছু শিখতে থাকে। তাই পরিবারে মা-বাবার পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা দরকার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী সদস্যকে পরিবারে অধীনস্থ করে রাখার প্রবণতা ও নারী নির্যাতন পারিবারিক বন্ধনকে জোড়াতালির আকারে রাখছে কিংবা ভেঙে দিচ্ছে। সুতরাং পারিবারিক পরিবেশ ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে প্রথম প্রভাব ফেলে সন্তানের ওপর। পাশাপাশি রয়েছে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন। তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, রয়েছে সামাজিক পরিবেশ।

স্বপ্না রেজাশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী শেখানো হচ্ছে, সেটা দেখা ও ভাবা ছিল অতীব জরুরি। দীর্ঘদিন একই ধারায় চলে আসছে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম। সময় ও জীবনধারা বদলালেও শিক্ষা কার্যক্রম বদলায়নি। তোতা পাখির মতো বিষয়ভিত্তিক যা শেখানো হচ্ছে তাতে শিক্ষার্থীর সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়ার সুযোগ নেই, বোঝার উপায়ও নেই। তথ্য, তত্ত্ব-উপাত্ত মুখস্থ করে তারা শিক্ষার সনদ নিচ্ছে এবং মেধা তালিকায় স্থান পাচ্ছে। এতে প্রকৃত মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার কোনো কারিকুলাম, অনুশীলন বা চর্চা কই? নেই। বুদ্ধির বিকাশটা থাকছে পাঠ্যপুস্তককেন্দ্রিক এবং তার স্বীকৃতি মিলছে কাগজের সনদে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক প্রভাব। স্কুল পরিচালনা কমিটি থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগে চলে রাজনীতিকরণ। ফলে শিক্ষার চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী হয়ে ওঠে মুখ্য। তাদের প্রভাব ও পেশিশক্তি হয় দৃশ্যমান। এর প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপরও। শিক্ষা অর্জনের চেয়ে প্রভাব ও আধিপত্যের প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং বিষয়টি তারা অনুশীলনে নিয়ে আসে। অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির যে চর্চা, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থকেন্দ্রিক। রাজনীতি গ্রাস করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। কোনোভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতির দুষ্টচক্র থেকে রক্ষা পায় না। শিক্ষা নয়, রাজনীতিতেই লাভ এই মনোবৃত্তি শিক্ষার্থীদের মাঝে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে।

সব ধরনের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশে আইন রয়েছে। কিন্তু নেই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারকার্যও ব্যাহত হয়। অপরাধের বিষয়টি ফিকে হয়ে পড়ে। আবার কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে অপরাধীর শাস্তি হয় না। বিবিধ কারণে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়ে যায়। এর থেকে শক্তি ও সাহস পায় অপরাধী এবং নতুন নতুন অপরাধের সৃষ্টি হয়। সোজা কথায়, সামাজিক দুর্বল অবস্থা দেখে এভাবে নতুন অপরাধীর জন্ম হয়। জিতুরা সেই দুর্বল কাঠামোরই সৃষ্টি।

সীমান্তে কড়া নজরদারির পরও মাদকদ্রব্য পৌঁছে যাচ্ছে যুবসমাজের হাতে। মাদকসেবনকারী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ধরা সম্ভব হলেও সীমান্তে কর্মরত প্রহরী ও গডফাদারদের ধরতে দেখা যায় না। নিরাপত্তাকর্মীদের কারও কারও মাদকাসক্তি ও মাদক কারবারে সম্পৃক্ততা এই ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। যুবসমাজের বিপথগামিতা ও হিরোইজমের জন্য এই মাদক বড় একটি কারণ। দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, মাদককে জিরো টলারেন্স হিসেবে হুঁশিয়ার করা হলেও মাদক নির্মূল হচ্ছে না কোনোভাবেই। কেন হয় না, তা কিন্তু অজানা নয়। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে চলে মাদক কেনাবেচা।

পাড়া-মহল্লায় বিপথগামী কিছু ‘বড় ভাই’ থাকে যাদের ছত্রচ্ছায়ায় কিশোরেরা তাদের আদলে বেড়ে ওঠে এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হিরোইজম দেখায়। এই বড় ভাইয়েরা স্থানীয় থানায় তালিকাভুক্ত অপরাধী হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফলে তাদের অনুসারী কিশোর অপরাধীদের ভেতর নির্ভয় বাসা বাঁধে। স্থানীয় মুরব্বিরা এদের ভয় পান আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে। বড় ভাইদের মাধ্যমে তারা অপরাধজগতে প্রবেশ করে আধিপত্য লড়াইয়ে যুক্ত হয়।

দেশে যে সংস্কৃতির চর্চা, অপসংস্কৃতি ও ভিনদেশীয় সংস্কৃতির যে অবাধ প্রবেশ, তা-ও কিশোরদের হিরোইজম দেখানোর একটি কারণ। সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে যারা ব্যতিব্যস্ত তারা শিশু-কিশোরদের জীবনগঠনে ইতিবাচকভাবে পথপ্রদর্শক হতে পেরেছেন কতটা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। দেশে রয়েছেন অনেক গবেষক, সমাজবিদ। শিশু-কিশোরদের ভয়ংকরভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠা নিয়ে রাষ্ট্রকে তাঁরা কী বোঝাতে সক্ষম হলেন, পরামর্শ দিলেন, নিজেদের ঘুম হারাম করলেন, তা নিয়েও সংশয়। অতিশয় হিংস্র ও ভয়ংকর অপরাধপ্রবণতার কারণগুলো নিয়ে যদি গবেষণা ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা যায় তাহলে জিতুদের সংখ্যা বাড়বে, এটা নিশ্চিত। কতটা বীভৎস হয়ে এরা হত্যা করতে পারে, জনসমক্ষে রিফাতকে পৈশাচিকভাবে খুন করা তার একটি দৃষ্টান্ত। এ রকম দৃষ্টান্ত কম নয়।

পরিশেষে বলব, একটি দেশের উন্নয়ন ও তার সুরক্ষার জন্য মানবসম্পদের চেয়ে বড় সম্পদ আর কিছুই নেই। আবার একটি দেশের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সেই মানবই, যদি না সে প্রকৃত শিক্ষা না পায়। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে, সন্তানকে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা এবং সতর্ক থাকা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তামিম কি তাহলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হবেন

রাজনৈতিক দলের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ, হেফাজতে সেনা কর্মকর্তা

পিআর পদ্ধতিতেই হবে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ, ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত

নারীর ‘বগলের গন্ধ’ পুরুষের মানসিক চাপ কমায়, তবে কি মানুষেরও আছে ফেরোমোন!

বাংলাদেশি পণ্যে ভারতের চেয়ে কম শুল্কের ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত