Ajker Patrika

যশোর পলিটেকনিকে বহিরাগতদের নির্যাতনে ছাত্রাবাসছাড়া ছাত্ররা

জাহিদ হাসান, যশোর
Thumbnail image

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না যাওয়াসহ নানা কারণে বহিরাগতদের হামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন যশোর সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের জন্য থাকা একমাত্র ছাত্রাবাস থেকে গত দেড় মাসে ৩০ জন আবাসিক শিক্ষার্থী চলে গেছেন। ছিনতাই, মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অত্যন্ত ২৫ জন। বর্তমানে ছাত্রাবাসটিতে যে শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন, তাঁরাও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো নিরাপত্তা পাননি, উল্টো আন্দোলনকারীদের ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। 
তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, বহিরাগতদের সঙ্গে ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের অবাধ চলাচল রয়েছে। এর ফলে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

শহরের শেখহাটি এলাকায় এই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসের ভেতরেই ছাত্রদের জন্য ২০০ শয্যার একমাত্র শহীদ অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন ছাত্রাবাস। ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, মাদক, ছাত্ররাজনীতির গ্রুপিং, বহিরাগতদের দাপটের কারণে ২০০৮ সালে এটি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এক যুগ পর গত ডিসেম্বর থেকে আবার ছাত্রাবাসটি চালু করা হয়।

আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ছাত্রাবাসটি আবার চালু হওয়ার পর থেকে স্থানীয় বহিরাগতরা আবার দাপট দেখাতে শুরু করে। মাদক সেবন করার জন্য এই ছাত্রাবাসে আসে। কোনো শিক্ষার্থী নিষেধ করলে তাঁকে তুলে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে। বিভিন্ন সময়ে তারা ছাত্রাবাসে এসে মারধর করে অস্ত্র ও ছুরি দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল, টাকা, ল্যাপটপসহ মূল্যমান জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এসব কারণে এরই মধ্যে ৩০ শিক্ষার্থী ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে গেছেন। কয়েকজন লেখাপড়া বন্ধ করে গ্রামে ফিরে গেছেন। অনেকেই ছাত্রাবাস ছেড়ে কলেজ থেকে দূরে বেসরকারি ছাত্রাবাসে উঠেছেন।

সম্প্রতি নির্যাতনের শিকার হয়ে মেকানিক্যাল বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী রিফাত আহমেদ ছাত্রাবাস ছেড়ে বেসরকারি ছাত্রাবাসে উঠেছেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ছাত্রাবাসে থাকার কোনো পরিবেশ নেই। বহিরাগতরা অবাধে চলাচল করে। মাদকদ্রব্য সেবন করে। বিনা কারণে আমাকেও মারধর করেছে। পরে ক্যাম্পাসের বাইরে গেলে আমিসহ আরও দুজনের কাছে থাকা তিনটি মোবাইল ও টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। এ বিষয়ে আমরা থানাতে অভিযোগ করিনি ভয়ে।’

নির্যাতনের শিকার হয়ে ছাত্রাবাস ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন একই বিভাগের পঞ্চম সেমিষ্টারের শিক্ষার্থী জয় বালা। মাগুরার মহম্মদপুরের বাসিন্দা এই শিক্ষার্থীকে মোবাইল ফোনে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ভয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, অনেক দূরদূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা অল্প খরচে থাকার জন্য সরকারি ছাত্রাবাসে ওঠেন। বহিরাগতরা জোর করে এসে তাঁদের দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে যায়।

সর্বশেষ গত রোববার বহিরাগত ৭-৮ জন এসে লোহার পাইপ, কাঠ আর অস্ত্র নিয়ে ছাত্রাবাসে ঢুকে আলামিন নামে এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যায়। পরে ক্যাম্পাসের বাংলাদেশ কারিগরি ছাত্র পরিষদের সভাপতি-সম্পাদকসহ শিক্ষার্থীরা আলামিনকে উদ্ধার করতে গেলে বহিরাগতরা তাঁদের ওপর হামলা করে। এতে সাতজন আহত হন। ঘটনাটি অধ্যক্ষকে জানালেও কলেজ প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। উল্টো প্রতিবাদ করা শিক্ষার্থীদের দ্রুত ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ।

ছাত্রাবাসের বাসিন্দা ও বাংলাদেশ কারিগরি ছাত্র পরিষদের যশোর শাখার সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহম্মেদ বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানিয়েছি; কলেজ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা বলে, কোনো অঘটন ঘটলে কলেজ প্রশাসন দেখবে। অধ্যক্ষ নিরাপত্তা না দিয়ে ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশনা দেন।’ 
হোস্টেল সুপার বাবলুর রহমান বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী চলে চলে গেছে—এমন তথ্য নেই আমাদের কাছে। মাঝে বহিরাগতরা ঝামেলা করার চেষ্টা করছিল; সেটা সিসি ক্যামেরা ফুটেজে রয়েছে।’ তবে ছাত্রাবাসে বহিরাগতরা এসে কোনো ছাত্রকে বাইরে দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে যায় না বলে তিনি দাবি করেন। 

ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী জি এম আজিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বহিরাগতরা ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের বন্ধু। ওরাই ডেকে নিয়ে আসে। তারপরও দু-একজন বহিরাগত এলে পুলিশকে জানালে চলে যায়।’ ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা আছে দাবি করে অধ্যক্ষ বলেন, ক্যাম্পাসে মসজিদ, খেলার মাঠ থাকাতে বহিরাগতদের যাওয়া-আসা বন্ধ করা যায় না। আর নির্যাতনের শিকার হয়ে ছাত্রাবাস ছেড়ে ছাত্ররা চলে যাচ্ছেন, এমন কোনো তথ্য তাঁর কাছে নেই বলে দাবি করেন তিনি। 

কারা এই বহিরাগত
স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইনস্টিটিউটের মেকানিক্যাল বিভাগের প্রথম সেমিস্টারে পড়াশোনা করেন স্থানীয় জীবন হোসেন। তিনি কলেজে অনিয়মিত। তাঁর সঙ্গে কিছু ছাত্রলীগের কর্মী ও গ্যাংয়ের সদস্যরা আসে ক্যাম্পাসে। জীবনের সঙ্গে ক্যাম্পাসে দাপট দেখায় স্থানীয় শেখহাটি ও ঘোপ এলাকার বাসিন্দা হৃদয়, ছোট সুমন, সাজিদসহ ৮ থেকে ১০ জন। তারা মাদকের টাকার জন্য ইনস্টিটিউটের আশপাশে ছিনতাই করে। এসব কিশোরেরা মূলত ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে চলাচল বলে।

অভিযোগের বিষয়ে দাপট দেখানো বহিরাগত কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সালাউদ্দিন কবির পিয়াস বলেন, ‘ছাত্রদের সঙ্গে ক্যাম্পাসে ঝামেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলব।’

এ বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ওই এলাকাতে মাঝেমধ্যে ছুরিকাঘাত, ছিনতাইয়ের ঘটনা শুনতে পাই আমরা। মাদক বেচাকেনা, মাদকের টাকার জন্য ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। তবে অভিযোগ পাওয়া যায় না। অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত