রুশা চৌধুরী
চারপাশের জটিল রসায়নের মাঝে জীবনটা যাপন করে যাচ্ছি আমরা। সকালের রেশম-নরম রোদ আর হালকা শিরশিরানি বলে যায়, ‘আমি শরতের ভোর দাঁড়িয়ে আছি তোমার দ্বারে।’ শরতের সঙ্গে মানুষের এক আপনভোলা সখ্য, যার রাখিবন্ধন হয় এক আস্ত উৎসবের হাত ধরে। তার নাম ‘পূজা’ অথবা ‘পুজো’। কান পাতলেই আবছা আবছা কানে আসে যে সুর, সেই সুর বহু আগে ফেলে আসা, দুলে দুলে গান গাইছে তারা! দোকানের সামনে ভিড়, ফুচকাওয়ালারা ঝাল বেশি আর কম নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, মুড়ালি-বাতাসা-দানাদারের পাহাড় নিয়ে ফেরিওয়ালার দল, দুটো গ্লাসে মাঠা ঢেলে ঢেলে তারপর একটা গ্লাসে ঢেলে দিচ্ছে লোকটা—ছবিগুলো কী জীবন্ত!
রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের ফাঁক দিয়ে ঘোষ কাকাদের বাড়ি, মিত্রবাবুদের আটচালায় মূর্তিতে রং ধরানো প্রায় শেষ হয়ে আসত, চক্ষুদান বাকি থাকত শুধু। মন্ত্রমুগ্ধ আমরা দেখতাম। পুজোর ঘ্রাণ তাজা করতেই সাদা রঙ্গনগাছটার মাথার দিকে কিছু কুয়াশা জমত, শিউলি ঝরাও শুরু হয়ে যেত, আর থাকত কামিনীর সুবাস!
‘বুঝলি সোনা, কমলা আলোটা গাছের ফোকর দিয়ে মাটিতে পড়বার আগেই ফুরিয়ে যাবে যখন, তখনই বুঝে যাবি পুজো এসে গেছে’—কানে ভেসে আসে ঘোষ কাকিমার স্বর। নাকে এসে লাগে ধূপকাঠির ঘ্রাণ। এই গন্ধে আজও কোনো ভেদাভেদ নেই।
সেই কোন ছোটবেলায় দেখা যেত, নবমীর দিন সকাল সকাল টিনের চকচকে চ্যাপ্টা বন্দুক আর রোল ক্যাপের গোলাপি ছোট ট্যাবলেটের মতো বাক্স নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে বেশ কিছু কিশোর। যেন রূপকথার রাজপুত্র আর তার বন্ধুরা। পটকার বারুদের গন্ধের সঙ্গে ধূপের গন্ধও মিশে যেত অনাহূত অতিথির মতো।
ঘোষ কাকুদের বাড়ির ছোট ছোট তিন ভাই গোসল করছে বেশ করে তেল মেখে। সরষের তেল। ঘোষ কাকু ঘানি থেকে নিয়ে আসতেন। বড্ড ঝাঁজ ছিল তাতে, আমরাও ভাগে পেতাম। প্রথমেই হাতের তালুতে নিয়ে দুই কানের ফুটো আর নাভিতে। তাহলে নাকি উত্তরে হাওয়ায় শরীরের রস শুকিয়ে যায় না। এ কথা ওদের পিসির কাছে জানা, আমরাও পিসি ডাকতাম। নিমের দুটো পাতা ফেলে দেওয়া হতো সেই তেলে। তেল মেখে, গামছা পরে ওরা রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াত আর আমরা লুকিয়ে ভাবতাম, ‘আহা! আমাদের কেন পুজো হয় না?’
ওদের বাড়ি থেকে আরেকটা গন্ধ আসত, ‘কেয়োকার্পিন’ তেলের। মাঝে মাঝে ‘জবাকুসুম’ তেলের গন্ধ আসত, যা মিলে যেত আমাদের বাড়ির সঙ্গে, তখন বেশ লাগত। সেই থেকেই জবাকুসুমের গন্ধ পেলেই পুজোর সব স্মৃতি মনের ভেতর হুড়মুড়িয়ে আসে।
ঘোষ কাকু গুনগুন করে গাইতেন, ‘জয় রাধাকৃষ্ণ, গোপালকৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ গোপালকৃষ্ণ...’। আমরা ভাইবোনেরাও বলতাম চুপিচুপি। কাকিমা আর আমাদের মা শুনলেও কিছুই বলতেন না।
গৌরাঙ্গ কাকা শালপাতায় মুড়িয়ে লুচি, সবজি, মিষ্টি আর অমৃতের স্বাদে মাখানো চালতার আচার নিয়ে আসতেন। কবজি ডুবিয়ে খেতে খেতে ছোট ভাইটা বলত, ‘দিদি, পুজোটা আমাদেরও তাই না?’
পুজোর সঙ্গে আরেকটা যে বিষয় খুব ছিল, তা হচ্ছে গান। সময়টাই ছিল গান দিয়ে মোড়ানো। সেগুলো ছাড়া পুজো ঠিক উৎসব হয়ে উঠত না, ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে...’, ‘নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে...’ কিংবা ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে’…। এখন আর এসব কেউ বাজায় না। তবু এ গানগুলোই নিয়ে যায় সেই পুজোর দিনগুলোতে। বুকের ওপর নতুন পুজোসংখ্যা নিয়ে ঝিমঝিম দুপুর আর আলসেমি ভরা সেই সন্ধ্যাগুলো যে আলো হয়ে আছে, সেই আলোই আজ জীবনের রং। দশমীর দিনে ছিল পুজো দেখতে যাওয়া। রথ, বাতাসা, মুড়ালি, খেলনা কিনে বাড়ি ফেরা...। আজ হাতের কাছে রামকৃষ্ণ মিশন যেমন নেই, তেমনি নেই সেই বাঁধনছেঁড়া ইচ্ছেরাও।
আমাদের নতুন জীবনে সেই ঘোষ কাকিমা বা গৌরাঙ্গ কাকারাও নেই! কোনো এক অদৃশ্য ব্যবধান মেনে হৃদয়ে হৃদয় যোগ করতে পারিনি আমরা। উচ্ছ্বসিত কলধ্বনি ভেসে আসে, তবু যা উপেক্ষা করা যায় না, তবু উপেক্ষা করাই এ যুগের নিয়ম। কী অবলীলায়ই তা করে যাই আমরা। দরজায় কন্যার ছায়া, ‘মা, আমাকে পুজো দেখাতে নিয়ে যাবে না?’
শিউরে উঠি। মন বলে, ‘আমি শিখিয়ে দিইনি, তবুও মেয়ে আমার ঠিক চিনে নিয়েছে!’
আমরা যা ‘আমাদের’ না রেখে ‘ওদের’ বা ‘তাদের’ করে দিতে চাইছি, মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভালোবাসারা ঠিক আমার উত্তরসূরিদের মনেও পৌঁছে দিয়েছে তা। কে বলে শুধু গায়ের জোরটাই আসল? সত্যি হচ্ছে এই ‘মন’ আর মনের ভেতরের যত্নে রাখা ‘ভালোবাসা’!
গুনগুন করে গান গাই—
‘আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে
ঢ্যামকুড়কুড় ঢ্যামকুড়কুড় বাদ্যি বেজেছে
গাছে শিউলি ফুটেছে কালো ভোমরা ছুটেছে’
লেখক: আবৃত্তিশিল্পী
চারপাশের জটিল রসায়নের মাঝে জীবনটা যাপন করে যাচ্ছি আমরা। সকালের রেশম-নরম রোদ আর হালকা শিরশিরানি বলে যায়, ‘আমি শরতের ভোর দাঁড়িয়ে আছি তোমার দ্বারে।’ শরতের সঙ্গে মানুষের এক আপনভোলা সখ্য, যার রাখিবন্ধন হয় এক আস্ত উৎসবের হাত ধরে। তার নাম ‘পূজা’ অথবা ‘পুজো’। কান পাতলেই আবছা আবছা কানে আসে যে সুর, সেই সুর বহু আগে ফেলে আসা, দুলে দুলে গান গাইছে তারা! দোকানের সামনে ভিড়, ফুচকাওয়ালারা ঝাল বেশি আর কম নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, মুড়ালি-বাতাসা-দানাদারের পাহাড় নিয়ে ফেরিওয়ালার দল, দুটো গ্লাসে মাঠা ঢেলে ঢেলে তারপর একটা গ্লাসে ঢেলে দিচ্ছে লোকটা—ছবিগুলো কী জীবন্ত!
রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের ফাঁক দিয়ে ঘোষ কাকাদের বাড়ি, মিত্রবাবুদের আটচালায় মূর্তিতে রং ধরানো প্রায় শেষ হয়ে আসত, চক্ষুদান বাকি থাকত শুধু। মন্ত্রমুগ্ধ আমরা দেখতাম। পুজোর ঘ্রাণ তাজা করতেই সাদা রঙ্গনগাছটার মাথার দিকে কিছু কুয়াশা জমত, শিউলি ঝরাও শুরু হয়ে যেত, আর থাকত কামিনীর সুবাস!
‘বুঝলি সোনা, কমলা আলোটা গাছের ফোকর দিয়ে মাটিতে পড়বার আগেই ফুরিয়ে যাবে যখন, তখনই বুঝে যাবি পুজো এসে গেছে’—কানে ভেসে আসে ঘোষ কাকিমার স্বর। নাকে এসে লাগে ধূপকাঠির ঘ্রাণ। এই গন্ধে আজও কোনো ভেদাভেদ নেই।
সেই কোন ছোটবেলায় দেখা যেত, নবমীর দিন সকাল সকাল টিনের চকচকে চ্যাপ্টা বন্দুক আর রোল ক্যাপের গোলাপি ছোট ট্যাবলেটের মতো বাক্স নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে বেশ কিছু কিশোর। যেন রূপকথার রাজপুত্র আর তার বন্ধুরা। পটকার বারুদের গন্ধের সঙ্গে ধূপের গন্ধও মিশে যেত অনাহূত অতিথির মতো।
ঘোষ কাকুদের বাড়ির ছোট ছোট তিন ভাই গোসল করছে বেশ করে তেল মেখে। সরষের তেল। ঘোষ কাকু ঘানি থেকে নিয়ে আসতেন। বড্ড ঝাঁজ ছিল তাতে, আমরাও ভাগে পেতাম। প্রথমেই হাতের তালুতে নিয়ে দুই কানের ফুটো আর নাভিতে। তাহলে নাকি উত্তরে হাওয়ায় শরীরের রস শুকিয়ে যায় না। এ কথা ওদের পিসির কাছে জানা, আমরাও পিসি ডাকতাম। নিমের দুটো পাতা ফেলে দেওয়া হতো সেই তেলে। তেল মেখে, গামছা পরে ওরা রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াত আর আমরা লুকিয়ে ভাবতাম, ‘আহা! আমাদের কেন পুজো হয় না?’
ওদের বাড়ি থেকে আরেকটা গন্ধ আসত, ‘কেয়োকার্পিন’ তেলের। মাঝে মাঝে ‘জবাকুসুম’ তেলের গন্ধ আসত, যা মিলে যেত আমাদের বাড়ির সঙ্গে, তখন বেশ লাগত। সেই থেকেই জবাকুসুমের গন্ধ পেলেই পুজোর সব স্মৃতি মনের ভেতর হুড়মুড়িয়ে আসে।
ঘোষ কাকু গুনগুন করে গাইতেন, ‘জয় রাধাকৃষ্ণ, গোপালকৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ গোপালকৃষ্ণ...’। আমরা ভাইবোনেরাও বলতাম চুপিচুপি। কাকিমা আর আমাদের মা শুনলেও কিছুই বলতেন না।
গৌরাঙ্গ কাকা শালপাতায় মুড়িয়ে লুচি, সবজি, মিষ্টি আর অমৃতের স্বাদে মাখানো চালতার আচার নিয়ে আসতেন। কবজি ডুবিয়ে খেতে খেতে ছোট ভাইটা বলত, ‘দিদি, পুজোটা আমাদেরও তাই না?’
পুজোর সঙ্গে আরেকটা যে বিষয় খুব ছিল, তা হচ্ছে গান। সময়টাই ছিল গান দিয়ে মোড়ানো। সেগুলো ছাড়া পুজো ঠিক উৎসব হয়ে উঠত না, ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে...’, ‘নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে...’ কিংবা ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে’…। এখন আর এসব কেউ বাজায় না। তবু এ গানগুলোই নিয়ে যায় সেই পুজোর দিনগুলোতে। বুকের ওপর নতুন পুজোসংখ্যা নিয়ে ঝিমঝিম দুপুর আর আলসেমি ভরা সেই সন্ধ্যাগুলো যে আলো হয়ে আছে, সেই আলোই আজ জীবনের রং। দশমীর দিনে ছিল পুজো দেখতে যাওয়া। রথ, বাতাসা, মুড়ালি, খেলনা কিনে বাড়ি ফেরা...। আজ হাতের কাছে রামকৃষ্ণ মিশন যেমন নেই, তেমনি নেই সেই বাঁধনছেঁড়া ইচ্ছেরাও।
আমাদের নতুন জীবনে সেই ঘোষ কাকিমা বা গৌরাঙ্গ কাকারাও নেই! কোনো এক অদৃশ্য ব্যবধান মেনে হৃদয়ে হৃদয় যোগ করতে পারিনি আমরা। উচ্ছ্বসিত কলধ্বনি ভেসে আসে, তবু যা উপেক্ষা করা যায় না, তবু উপেক্ষা করাই এ যুগের নিয়ম। কী অবলীলায়ই তা করে যাই আমরা। দরজায় কন্যার ছায়া, ‘মা, আমাকে পুজো দেখাতে নিয়ে যাবে না?’
শিউরে উঠি। মন বলে, ‘আমি শিখিয়ে দিইনি, তবুও মেয়ে আমার ঠিক চিনে নিয়েছে!’
আমরা যা ‘আমাদের’ না রেখে ‘ওদের’ বা ‘তাদের’ করে দিতে চাইছি, মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভালোবাসারা ঠিক আমার উত্তরসূরিদের মনেও পৌঁছে দিয়েছে তা। কে বলে শুধু গায়ের জোরটাই আসল? সত্যি হচ্ছে এই ‘মন’ আর মনের ভেতরের যত্নে রাখা ‘ভালোবাসা’!
গুনগুন করে গান গাই—
‘আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে
ঢ্যামকুড়কুড় ঢ্যামকুড়কুড় বাদ্যি বেজেছে
গাছে শিউলি ফুটেছে কালো ভোমরা ছুটেছে’
লেখক: আবৃত্তিশিল্পী
ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ দিন আগেআধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
০৮ মে ২০২৫