Ajker Patrika

ইউক্রেনে কি শেষ খেলা শুরু হয়েছে

সের্গেই স্ট্রোকান
ইউক্রেনে কি শেষ খেলা শুরু হয়েছে

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ৬৩০ দিন পেরিয়ে গেল। এই সামরিক সংঘাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গভীরতম আন্তর্জাতিক সংকটের সূত্রপাত করেছিল। সেই সংঘাতই অবশেষে একটি কৌশলগত চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছে যাচ্ছে।

যুদ্ধের সর্বশেষ খবরাখবর বলছে, পশ্চিমাদের সক্রিয় সমর্থনে চলতি বছরের জুনের প্রথম দিকে শুরু হওয়া ইউক্রেনের বহু-বিজ্ঞাপিত পাল্টা আক্রমণ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। নভেম্বরের শুরুতে লড়াই যেন কয়েক মিটারের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের ঝড় যেন তার সব শক্তি হারিয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়েছে।

ক্রেমলিনের ইউক্রেন কৌশল নিয়ে মস্কোর কেউ প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু কিয়েভে তা আমূল বদলে গেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী মার্চে হবে বলে নির্ধারিত। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির খুব কাছের বেশ কয়েকজন সদস্য গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর থেকে কিয়েভে বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞার বেড়া ভেঙে ফেলছিলেন। ফেব্রুয়ারিতেই মস্কো ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে।

রাজনৈতিক, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সামরিক কর্তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ইউক্রেন তার হারানো অঞ্চলগুলো পুরোপুরি ফিরে পাবে। শুধু ফিরেই পাবে না, ১৯৯১ সালের সীমানায় পৌঁছে যাবে, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় ছিল। রাশিয়ার মস্কোতে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করবে। তাঁদের সুর এখন বদলে গেছে।

এখন ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে। তাঁরা কেবল রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় অর্জনের সম্ভাবনাকে অসম্ভব বলে মনে করেন না; বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে মনে করেন। অনিচ্ছায় তাঁরা স্বীকার করেন, কিয়েভকে তার হারানো ভূখণ্ডের বিষয়টি মেনে নিতে হবে। এটা মেনে নিয়ে রাশিয়ার কাছে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মস্কোর সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা।

কিয়েভের যাঁরা খবরের জন্ম দেন, তাঁদের অন্যতম ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ ভ্যালেরি জালুঝনি, যিনি ইউক্রেনের ক্ষমতার অনুক্রমে দুই নম্বর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত, একই সঙ্গে সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদের প্রত্যাশী। আপাতদৃষ্টিতে তিনি জেলেনস্কিকে চ্যালেঞ্জ করেই ফেলেছেন; বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ-কৌশলকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জেনারেল জালুঝনি স্বীকার করেছেন, ইউক্রেনীয় সৈন্যদের দ্বারা সম্ভবত যুদ্ধের ফ্রন্টের ‘ভালো ও গভীরতর কোনো অগ্রগতি’ হবে না। রাশিয়ার সঙ্গে ২১ মাসের সশস্ত্র সংঘর্ষের ফলাফলের সংক্ষিপ্তসারে, তিনি নতুন পর্যায়ে প্রবেশের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, এই ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য উপকারী, ইউক্রেনের জন্য নয়।

দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধে ইউক্রেনীয় জেনারেল স্বীকার করেছেন, রাশিয়া বিমান হামলায় একটি উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। এদিকে পাল্টা আক্রমণসহ যেকোনো বড় স্থল অভিযানের জন্য ইউক্রেনকে আকাশে আধিপত্য অর্জন করতে হবে।

ইউক্রেনের এই জেনারেল আরও স্মরণ করেন, রাশিয়া তার ইলেকট্রনিক যুদ্ধ-কৌশল আধুনিকীকরণ করেছে এবং তা ইউক্রেন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। যখন পশ্চিমারা ইউক্রেনকে আধুনিক আর্টিলারি দিয়েছিল, তখন কিয়েভ কিছুটা সুবিধা অর্জন করেছিল। কিন্তু এরপর রাশিয়ান ইলেকট্রিক যুদ্ধ-কৌশলের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই সুবিধা তলিয়ে যায়।

এর সঙ্গে আবার ইউক্রেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে মাইন সরানোর ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। দেড় বছর আগে, ইউক্রেনে মাইন অপসারণের জন্য অল্প কিছু পুরোনো সরঞ্জাম ছিল। এ কাজে ব্যবহৃত পশ্চিমা সরঞ্জামগুলো আরও ভালোভাবে কাজ করে, তবে এর সংখ্যা যথেষ্ট নয়।

এর বাইরে ইউক্রেন সেনাবাহিনীতে নতুন সদস্য সংগ্রহে সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নাগরিকেরা যাতে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ এড়াতে না পারে, সে জন্য শুধু আইন পরিবর্তন করাটাই যথেষ্ট নয়।

জালুঝনির যুক্তি, যুদ্ধ একটি অচলাবস্থায় পৌঁছেছে, যা ইউক্রেনকে নিঃশেষ করে দিতে পারে। তিনি এ জন্য ন্যাটোর সামরিক কর্তাব্যক্তিদের সমালোচনা করেছেন। ন্যাটোর পাঠ্য অনুসারে, ইউক্রেনীয় সৈন্যদের চার মাসের মধ্যে ক্রিমিয়ায় পৌঁছানোর কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা গভীর মাইনফিল্ডে আটকে গেছে।

জালুঝনির মতে, ‘অচলাবস্থা কাটাতে আমাদের নতুন কিছু দরকার, যেমন চীনাদের আবিষ্কৃত গানপাউডার, যা আমরা এখনো একে অপরকে হত্যা করার জন্য ব্যবহার করি।’ তাঁর মতে, অদূর ভবিষ্যতেও কোনো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের বিষয়টি তিনি দেখছেন না। তারপরও ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ পশ্চিমারা এর ওপর সর্বোচ্চ চাপ দিচ্ছে।

এদিকে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত জেনারেল জালুঝনির স্বীকারোক্তির প্রতিধ্বনি করে, ইউক্রেনের বিখ্যাত সাংবাদিক ও টিভি উপস্থাপক সাইমন শুস্টার প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির দলের সদস্যদের নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, ওই দলে ভিন্নমত শোনা যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। শুস্টার মনে করেন, শুধু ইউক্রেনীয় নেতা (জেলেনস্কি) নিজেই এবং তাঁর দলের কিছু লোক এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করেন 
যে কিয়েভের সামরিক বিজয় হবেই এবং তা ১৯৯১-এর সীমানায় পৌঁছাবে।

টাইমের নিবন্ধটি ইউক্রেনের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মতপার্থক্যেরই উদাহরণ তুলে ধরে; বিশেষ করে সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাফল্য চায় এবং সেই কাজ করার জন্য সামরিক নেতৃত্বের হাতে কোনো রসদ নেই।

কিয়েভে দেওয়া বিবৃতির ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘রাশিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে বিশেষ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, ‘যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। এমনকি যুদ্ধে কিয়েভের জয়ের কোনো সম্ভাবনার কথা বলাও অযৌক্তিক।’ তাঁর মতে, ইউক্রেন যত তাড়াতাড়ি এটি বুঝতে পারে, তত তাড়াতাড়ি তার জন্য কিছু সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে।

এদিকে, কিয়েভে আরেকটি বোমা ফাটিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাবেক উপদেষ্টা আলেক্সি আরেস্তোভিচ, যাঁকে আগামী মার্চে প্রেসিডেন্ট পদের অন্য সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে। নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে, আলেক্সি আরেস্তোভিচ তাঁর ১৪-দফা রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন; বিশেষ করে পাল্টা আক্রমণ পরিত্যাগ করার এবং ‘কৌশলগত প্রতিরক্ষায়’ পরিবর্তনের। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য নীতিমালাকে ‘মানবিক’ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

আলেক্সি আরেস্তোভিচ বলেছেন, ‘সম্মিলিত পশ্চিমাদের কাছে আমার প্রস্তাব হলো, আমরা কিসিঞ্জারের প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত। আমরা ন্যাটোতে প্রবেশের দাবি জানাচ্ছি একটি বাধ্যবাধকতাসহ যে প্রবেশের সময় দখল হয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা হবে না। তবে শুধু রাজনৈতিক উপায়ে তাদের ফিরে পেতে চাই।’

সর্বোপরি, ইউক্রেনের সংঘাতে একটি নতুন নাটকীয় মোড় নিচ্ছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে; যা আমরা সম্ভবত আগামী বছরের শুরুতে দেখতে পাব ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আর এই নির্বাচন হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে।

সের্গেই স্ট্রোকান, রুশ লেখক ও মস্কোভিত্তিক ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক

(ভারতীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইন্ডিয়া ন্যারেটিভে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত