Ajker Patrika

উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেমের দোদুল্যমানতা

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭: ৪১
Thumbnail image

যখন ১৪৪ ধারা ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে ১০ জনি মিছিলগুলো বেরোচ্ছিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন কী করছিলেন? তিনি যদি তখন বলিষ্ঠ কোনো অবস্থান নিতে পারতেন, তাহলে কি সেদিন গুলিবর্ষণ হতো না? দিনটি হতে পারত অন্য রকম?

ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চু লিখেছেন, ‘...১৪৪ ধারা না ভাঙার অনুরোধ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের কাছে আসেন ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রক্টর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ডিন জুবেরী ও ড. নিউম্যান। উপস্থিত ছাত্ররা বিনয়ের সঙ্গে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।’

শিক্ষার্থীরা যখন ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, তখন অলি আহাদ আনিসুজ্জামানকে নিয়ে গিয়েছিলেন মধুর ক্যানটিনে। তিনি যুবলীগ অফিসের চাবি আনিসুজ্জামানের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, যুবলীগের সব জেলা শাখার ঠিকানা এবং ভাষা আন্দোলনসংক্রান্ত ফাইল অফিস থেকে নিয়ে আনিসুজ্জামান যেন নিজের কাছে রাখেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের প্রথমে পুলিশ রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। তারপর ট্রাকে করে তেজগাঁও থানায় নিয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে পাঠায় জেল-হাজতে। গেট দিয়ে ছাত্রীরা যাতে বের হতে না পারে, সে জন্য গেটে একবার লাঠিচার্জ করে। এরপর আমাদের উত্তেজনাও বৃদ্ধি পায়।’

পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, দৌড়ে যায় কলাভবনের পুকুরের দিকে। পুলিশ গেটের মধ্যে ঢুকে লাঠিচার্জ করে। সে সময় কলাভবনের দোতলার করিডরের পুব দিকে কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। ছাত্রীরা তাঁকে চাপ দিচ্ছিল, বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের প্রবেশ ও হাঙ্গামার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানাতে। উপাচার্য এর আগে শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে ১৪৪ ধারা না ভাঙতে অনুরোধ করেছিলেন, তাই ওই সময় তাঁকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল।

সরদার ফজলুল করিমের লেখা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ’ বইটিতে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বয়ানে কিছু কথা রয়েছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘এ ব্যাপারে ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের কথা বলতে যেয়েই অধ্যাপক রাজ্জাক বললেন, “১৯৫২-তে ভাষা আন্দোলনের সময়ে, আর কিছুর জন্য নয়, সাহসের অভাবে, হি অকেজড মাচ ট্রাবল।

আমার মনে আছে যেদিন গুলিটা হলো, ইউনিভার্সিটির ওই পুরোনো দালানে (বর্তমান মেডিকেল কলেজ হসপিটাল বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ দিক) ছাত্র-শিক্ষক সব মিলিং এরাউন্ড। একবার হঠাৎ এই ভিড়ের মধ্যে তার সঙ্গে আমার দেখা। ছাত্ররা প্রসেশন করে বাইরে যাবার চেষ্টা করছে। রাস্তার পাশে গেট বন্ধ করে দিয়ে তাদের কোনো রকম ঠেকাবার চেষ্টা করা হচ্ছে।’’ এ সময় আবদুর রাজ্জাক সৈয়দ সাহেবকে বলেন, “আপনি সহজেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারতেন।” ‘‘কেমনে?’’ রাজ্জাক বলেন: ‘‘এইগুলো ছেলেরা করছে ক্যান? দে হ্যাভ নো কনফিডেন্স ইন ইউ। আপনি তাদের সঙ্গে আছেন, এই বিশ্বাস তাদের নাই।

এই বিশ্বাস যদি তাদের হয় তাহলে নিশ্চয়ই তারা এক্সট্রিমে যাবে না।” সৈয়দ সাহেব বললেন, “আমার কী করতে হবে?” রাজ্জাক সাহেব বললেন, “আপনি ছেলেদের বলুন যে, ইট ইজ ইনঅ্যাডভাইজেবল টু গো আউট ইন প্রসেশন। তবে তোমরা যদি প্রসেশন নিয়ে বার হও তবে সে প্রসেশন আমি লিড করব। আপনি ভিসি হিসেবে যদি বাইরে যান, তবে পুলিশ নিশ্চয়ই গুলি করবে না। করতে পারে না এবং ছেলেদের ইমোশন ক্যান বি কামড ডাউন। তাদের শান্ত করা যায়।” রাজ্জাক সাহেব যখন এই কথা বলছিলেন, তখন এক কলিগ, সিনিয়র শিক্ষক এসে জানতে চাইলেন, আবদুর রাজ্জাক কী বলছে। সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন সেটা বলার পর এই জ্যেষ্ঠ শিক্ষক রাজ্জাক সাহেবের কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “না এসব কি কথা? চলুন, আমরা ওদিকে যাই।’’’ 

সেদিন সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেন যদি বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতেন, তাহলে কি একুশের ট্র্যাজেডি এড়ানো যেত? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না আর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত