Ajker Patrika

পরপর আগুন, সন্দেহ সবার

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
পরপর আগুন, সন্দেহ সবার

রাজধানীর বঙ্গবাজারে আগুনের পর স্বাভাবিকভাবেই নিউমার্কেট ও এর লাগোয়া নিউ সুপার মার্কেটে ভিড় বেড়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন মাঝরাত পর্যন্ত চলছিল ঈদের বেচাকেনা। দিনের বেচাকেনা শেষ করে শ্রান্ত ব্যবসায়ীরা যখন চোখের দুই পাতা এক করেছিলেন, ঠিক তখনই ভয়াবহ আগুন। কাকডাকা ভোরে সবার চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল নিউ সুপার মার্কেটের ৬০০টির মতো দোকান। ব্যবসায়ীদের দাবি, ক্ষতি হয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার।

১১ দিন আগে ৪ এপ্রিল ঢাকার আরেক বড় বাজার বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে গেছে ৬ হাজারের মতো দোকান। ঈদের আগে কয়েক দিনের ব্যবধানে পরপর দুই মার্কেটে এমন আগুনকে দুর্ঘটনা বলতে চাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তাঁদের সন্দেহ, এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়। পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।

ব্যবসায়ীদের এমন সন্দেহ উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রায় কেউই। পুলিশপ্রধান, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক, ডিএমপির কমিশনার, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। একের পর এক আগুন দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা, এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন তাঁরা। বিষয়টি তদন্ত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনার কারণ পুলিশ খতিয়ে দেখছে। এর পেছনে যদি কোনো নাশকতার ঘটনা থাকে, তাহলে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

আগুন যখন জ্বলল
গতকাল শনিবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নিউ সুপার মার্কেটের দক্ষিণ ভবনে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। তিনতলা ভবনটিতে ১ হাজার ৩০০টির মতো দোকান রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিটের সাড়ে তিন ঘণ্টার কাজের পর সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মালেক, আব্দুর সবুর, মমতাজ ও নাহিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগের রাতেও প্রায় রাত ৩টা পর্যন্ত মার্কেট জমজমাট ছিল। বেচাকেনা শেষে দোকান বন্ধ করে বাসায় গিয়ে সাহ্‌রি খেয়ে মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। কিছুক্ষণ পরই জানতে পারেন মার্কেটের তৃতীয় তলায় আগুন লেগেছে। দৌড়ে গিয়ে দেখেন, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আকাশ ভরে গেছে। মার্কেটের ভেতরে ঢোকা তখন বিপজ্জনক। চোখের সামনে দোকানগুলো পুড়ে যাচ্ছে।

বন্ধুর ডাকে দোকানের মালামাল উদ্ধারের সহায়তা করতে এসেছিলেন মো. সাইফ। তিনি বলেন, ‘আমরা আসতে দেরি করে ফেলেছি। ভেতরে ঢুকে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। মালামাল তেমন বের করতে পারি নাই। সব শেষ ওদের, কিছুই বের করতে পারেনি।’

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, আগুনের সূত্রপাত ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে। এর ৪ মিনিট পরেই তারা ঘটনাস্থলে হাজির হয় ৪টি ইউনিট নিয়ে। শুরু থেকেই তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে আগুনের বেগ নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তিন ঘণ্টার আগে সেটা করতে পারেনি। ততক্ষণে সব পুড়ে ছাই। 

আগুন নিয়ন্ত্রণে ভোর থেকে কাজ করা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মী মোতাহার জানান, তিনি প্রথম ইউনিটের সঙ্গেই ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁরা এসে দেখেন গাউছিয়া মার্কেট থেকে যে পদচারী-সেতু নিউ সুপার মার্কেটের তিনতলার মুখে ঢুকেছে, ঠিক সেখানেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। আগুন পুড়তে পুড়তে সোজা পশ্চিম দিকে মার্কেটের ভেতর দিকে এগিয়ে চলছিল। আগুনের ভয়াবহতা বাড়তে থাকায় ৬টা ১৫ মিনিট নাগাদ ফায়ার সার্ভিসের ১৮ ইউনিট কাজে যোগ দেয়। তখনই পাশে সদর দপ্তর থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় বিজিবির ১২ প্লাটুন সদস্য।

ততক্ষণে নিউমার্কেট থানার পুলিশও তার আগে ঘটনাস্থলে চলে আসে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পাশের ঢাকা কলেজের পুকুরে সাতটি মেশিন বসান। এতে পানির সংকটে পড়তে হয়নি তাঁদের। তবে আগুনের বেগ সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে। তিনতলার আগুন তখন দোতলায় নামতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে ততক্ষণে একে একে যোগ দেয় র‍্যাব, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট বেড়ে হয় ৩০টি। তবুও আগুনে নিয়ন্ত্রণে আসছিল না।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, মার্কেটটির দোকানগুলোতে প্রচুর মালামাল স্তূপ করে রাখা ছিল। সেগুলো আগুনে পুড়তে থাকায় ধোঁয়া হয় প্রচুর। এমন ধোঁয়া তিনি কখনো দেখেননি।

সকাল আটটার পর থেকেই সিটি কলেজের সামনে থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তা ব্লক করে দেওয়া হয়। আগুনের বেগ ততক্ষণে একটু কমে আসে। ব্যবসায়ীরা বস্তা নিয়ে দুইতলা আর তিনতলায় ঢুকতে থাকেন ঝুঁকি নিয়ে। বস্তায় নতুন কাপড় ভরে মার্কেটের মুখে আনছেন।

তাঁদের হাত থেকে বস্তা কাঁধে করে নিয়ে রাস্তায় রাখছেন পুলিশ, সেনাবাহিনী, র‍্যাবের সদস্যরা। আগুন, ধোঁয়া ও ময়লা থেকে রক্ষা করে নিউমার্কেট এলাকার চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনের রাস্তায় স্তূপ করে তা রাখা হচ্ছে। সেখানে মালামাল পাহারা দিচ্ছিলেন বিজিবি ও ব্যবসায়ীর স্বজনেরা। ৯টা ১০ মিনিটের দিকে আগুন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসে। উৎসুক জনতা তখনো ঘিরে রয়েছেন নিউমার্কেট। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার না জেনে দূর থেকে ঈদের কেনাকাটাও করতে এসেছেন।

আগুন নিয়ন্ত্রণের সুবিধার জন্য এর আগে পাশের নূরজাহান মার্কেট, গ্লোব সুপার মার্কেট, বদরুদ্দোজা সুপার মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদনী চক, নিউমার্কেট ও চন্দ্রিমা মার্কেটের দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়।

বঙ্গবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগছে, এটা নাশকতা কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘একের পর আগুন লাগছে। এমন কিছু আছে কি না—এটি খতিয়ে দেখার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করব।’

পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ) লে. কর্নেল রেজাউল করিম জানান, মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল ছিল।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগুনে পুড়েছে ৬০০টির মতো দোকান। এ ছাড়া পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও প্রায় ২০০ দোকানের মালামাল। সব মিলিয়ে ক্ষতি কয়েক শ কোটি টাকার।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেটের সামনের যে পদচারী-সেতু ব্যবহার করে ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ঢুকতে হয়, সেটা ভাঙতে কাজ করছিল সিটি করপোরেশনের লোকজন। ঈদের আগে সেতুটি ভাঙতে নিষেধ করেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সেসবের পাত্তা না দিয়ে গতকাল ভোররাতেও সেটা ভাঙার কাজ চলছিল।

ব্যবসায়ীরা বলেন, ভোর চারটার দিকে সিটি করপোরেশনের একদল লোক নিউ সুপার মার্কেটের পূর্ব পাশের সিঁড়ি বিনা নোটিশে ভাঙতে আসেন। ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে দিতে বলেন, কিন্তু সিটি করপোরেশনের লোকজন কারও কথা না শুনে সিঁড়ি ভাঙা শুরু করেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই হঠাৎ মার্কেটের নিচতলা ও তিনতলায় বিকট শব্দ হয় এবং ধোঁয়া বের হতে থাকে।

মো. রুবেল নামের এক দোকানকর্মী বলেন, ‘রাতের বেলা সিটি করপোরেশনের লোকেরা ওভারব্রিজ ভাঙার কাম করছে (গাউছিয়া ও ঢাকা সুপার মার্কেটের সংযোগ পদচারী-সেতু)। ব্রিজের যে সিঁড়ি, ওইটার লগে অনেক তার আছিল এই মার্কেটের। আমরা সন্দেহ করি, ওই সিঁড়ি ভাঙার সময় তার প্লাস-মাইনাস (নেগেটিভ-পজিটিভ) হইয়া এই আগুন লাগছে ৷ কারণ, আগুন লাগার লগে লগে সিটি করপোরেশনের লোকেরা ভাগছে। এক মিনিটও দেরি করে নাই।’

অবশ্য পদচারী-সেতুটি থেকে আগুন লেগেছে—এমন তথ্যকে গুজব বলে অভিহিত করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। 

আহত ফায়ারকর্মীসহ ৩২ জন
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ ও নানাভাবে আহত হয়ে ৩২ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। আহতদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য রয়েছেন ৯ জন। 

তদন্ত কমিটি হয়নি
গতকাল রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন কোনো সংস্থাই কোনো কমিটি করেনি। আগুন পুরোপুরি নেভানো যায়নি। রাত ৯টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, ছাদ ফুটো করে ভবনের ভেতরে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর কাজ চলছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত