Ajker Patrika

স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে মাহফুজরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
Thumbnail image

মাথার ওপর চৈত্রের দুপুরের কড়া রোদ। দীর্ঘ লাইনে অন্তত ৩০০ মানুষ। লাইনের মাঝামাঝি হাতে একটি দোকানের আধপোড়া ক্যাশমেমো ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সাইফ খান মাহফুজ (২০)। চোখেমুখে ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা। নিচু স্বরে সামনে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলেন। লাইনে দাঁড়ানোর কারণ জানতে চাইলে বললেন, দোকানমালিক কাগজ নিয়ে দাঁড়াতে বলায় এসেছেন।

গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে এই লাইনের শেষ মাথা ছিল পুলিশ সদর দপ্তরের প্রধান ফটকের সামনে, যা শুরু হয়েছে এনেক্সকো টাওয়ারের সামনে থেকে। আগুনে বঙ্গবাজারসহ সাতটি মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের কর্মচারীদের জন্য সেখানে খোলা হয়েছে ‘তথ্য সংগ্রহ ও সহায়তা কেন্দ্র।’ এটি খুলেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এখানে নিজেদের নাম নিবন্ধন করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন মাহফুজ ও তাঁর সঙ্গী। এসেছিলেন তাঁদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটগুলোর দোকানের কর্মচারীরা।

উজ্জ্বল ফর্সা মাহফুজ ১০ বছর ধরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের লামিয়া গ্যালারি নামের একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। বাবা-মা, ভাই-বোন মিলিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার তাঁর রোজগারের ওপর নির্ভরশীল। অথচ তাঁর কর্মস্থল বঙ্গবাজার মঙ্গলবারের আগুনে পুড়ে ছাই। সামনে ঈদ। অন্যান্য বছর ঈদে বেতন, বোনাস, বখশিশ মিলিয়ে অনেক টাকা আয় হতো তাঁর। এবার সবই অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছে তাঁকে।

ঈদ করবেন কীভাবে–এমন প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন মাহফুজ। তারপর প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলেন। সেটা মেলে ধরে বললেন, ‘এই দেহেন, টাকা নাই কাছে। ঈদ করমু কেমনে—এই প্রশ্নের জবাব আমি কী দিমু! আমার কাছে কোনো জবাব নাই।’ তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। অল্প বয়সেই ঢাকায় এসে দোকানে কাজ করছেন। কথা বলতে বলতে এক সময় মাটিতে বসে পড়লেন। পাশে থাকা জাকির হোসেন নামের আরেক দোকানকর্মী বললেন, ‘বাড়িত যাওনের ভাড়া নাই। ঈদ তো বহু দূরের কথা। বাড়িতে স্ত্রী আর ছোট দুইডা মাইয়া আছে। এইবার খালি হাতে ওগো সামনে গিয়া খাড়ামু কেমনে!’

মাহফুজ ও জাকিরের মাসে বেতন ৯ হাজার টাকা। বছরে একবারই তাঁরা বেতনের সমপরিমাণ বোনাস পান। সঙ্গে যুক্ত হয় বড় পাইকারি ক্রেতাদের কাছ থেকে পাওয়া পার্টি বোনাস (বখশিশ)। মাহফুজ-জাকিরদের মতো কর্মচারীরা রোজার ঈদের আগে এই পার্টি বোনাসের অপেক্ষায় থাকেন সারা বছর। কারণ, এই সময় সব মিলিয়ে কেউ কেউ কয়েক লাখ টাকা আয় করেন। এই টাকায় গ্রামে জমি বন্ধক নেন, কেউ পছন্দের জিনিস কেনেন আর কেউ আরও কিছু টাকা যুক্ত করে নেমে পড়েন ব্যবসায়। কিন্তু এবার সব স্বপ্ন পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। 
কথা বলতে বলতে লাইন আরও দীর্ঘ হয়েছে। কথা হলো লাইনে দাঁড়ানো আরও কয়েকজনের সঙ্গে। নাম, পরিচয় ও বাড়ি আলাদা হলেও এবারের ঈদ নিয়ে সব দোকান কর্মচারীর গল্পটা একই রকম। সব স্বপ্ন পুড়ে গেছে এই আগুনে।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, মালিক সমিতি ও কর্মচারীদের হিসাব অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত সাতটি মার্কেটের প্রায় ছয় হাজার দোকান পুড়েছে। এসব দোকানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করতেন প্রায় ৩০ হাজার কর্মচারী। অনেকের পরিবারই তাঁদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। আগুনে নিঃস্ব হয়েছেন দোকানমালিকেরা। আর আয় নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন কর্মচারীরা ও তাঁদের পরিবার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত