Ajker Patrika

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জালিয়াতি: প্রশিক্ষণের ভুয়া বিলে ২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ, বিদেশে পাচার

মারুফ কিবরিয়া, ঢাকা
আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৪, ১০: ২৩
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জালিয়াতি: প্রশিক্ষণের ভুয়া বিলে ২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ, বিদেশে পাচার

দক্ষতা বাড়াতে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়া থেকে প্রশিক্ষণ নেবেন ৭২ জন চিকিৎসক ও কর্মকর্তা। কিন্তু এ জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে থাইল্যান্ডের থামাসাট ইউনিভার্সিটির অনুকূলে একটি ব্যাংক হিসাবে।

পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে উঠে আসে, এই ব্যাংক হিসাবটি ছিল সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের তৎকালীন এপিএস শেখ আরিফুর রহমানের ভাই শেখ আলতাফুর রহমানের। আর প্রশিক্ষণের জন্য ইউনিভার্সিটি অব মালায়ার যে ই-মেইল আইডিতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল, সেটিও ছিল ভুয়া। মূলত জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের জন্য বাংলাদেশে বসেই ওই ই-মেইল আইডি খোলা হয়।

শুধু এটি নয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) আওতায় প্রশিক্ষণের নামে এ রকম সাতটি জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে দুদক। এতে প্রায় ২২ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। এসব ঘটনার সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ও লাইন ডিরেক্টর নাজমুল ইসলামসহ ১১ জনের নাম উঠে এসেছে।

জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যরা হলেন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার তৎকালীন প্রোগ্রাম ম্যানেজার (বৈদেশিক প্রশিক্ষণ) মো. নাসির উদ্দিন, ডা. শামীম আল-মামুন, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. লায়াল হাসান, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. আলমগীর হোসেন, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সুভাষ চন্দ্র দাস, থামাসাট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ড. শেখ আলতাফুর রহমান, থাইল্যান্ডে বসবাসরত সরফরাজ নেওয়াজ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক কনসালট্যান্ট ডা. আনোয়ার জাবেদ।

দুদক সূত্রে জানা যায়, একটি স্মারকে ৪২ জন চিকিৎসক-কর্মকর্তা মালয়েশিয়ার মাহশা ইউনিভার্সিটি মেডিসিন ফ্যাকাল্টি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য খরচ হয়েছে ৭০ লাখ ৩১ হাজার টাকারও বেশি। পরে দুদক যোগাযোগ করে জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে এ ধরনের কোনো প্রোগ্রামের সংশ্লিষ্টতা নেই। অর্থাৎ জালিয়াতির মাধ্যমে পুরো অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক নাজমুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, তিনি এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন। অপরদিকে স্বাস্থ্যের সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদকে আটবার কল করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি। পরে তাঁর ফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি। 

এইচপিএনএসপি কর্মসূচির আওতায় ৫৬ জনকে প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ করা হয় অন্য এক স্মারকে। ওই প্রশিক্ষণের জন্য একটি ব্যাংক হিসাবে থাইল্যান্ডের পাইথাই নওয়ামিন হসপিটাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দুবারে ৭ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। প্রকৃতপক্ষে ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে এসব টাকা পাঠানো হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

আরেকটি স্মারকে অনুমোদিত ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠান এআইটি নেটওয়ার্কের নামে ৮ জনকে প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে, ওই প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলাদেশে বসে তৈরি কথা একটি ই-মেইল আইডিতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। ওই প্রশিক্ষণের নামে ইন্দোনেশিয়াতে প্রশিক্ষণার্থীদের কথা বলে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের হিসাবে ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। একইভাবে আরেকটি স্মারকে ৫৩ জনের প্রশিক্ষণের কথা বলে একইভাবে আরও ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হয়।

এ ছাড়া আরেকটি স্মারকে শ্রীলঙ্কার কনকুয়েস্ট সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৯ জনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।  সেখানে প্রশিক্ষণের কথা বলে দেশটির একটি ব্যাংক হিসাবে ৩০ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছিল। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কনকুয়েস্ট সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়।

১৮ জনকে ইন্দোনেশিয়ার পিটি এআইটি জেজারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নেওয়া কথা বলা হয় অপর একটি স্মারকে। দুদকের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, এ নামে দেশটিতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এটি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ওই প্রশিক্ষণের কথা বলে দেশটির একটি ব্যাংক হিসাবে দুবারে ১ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠানো হয়।

দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, অনুসন্ধানে স্বাস্থ্যের সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান এখনো চলমান। শেষ হলে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

অভিযুক্তদের মধ্যে নাম আসা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার তৎকালীন প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম আল মামুনের সঙ্গে কথা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলাম। এই কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল না। আমার নামে ওঠা অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’ এই চিকিৎসক জানান, তিনি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন।

এই জালিয়াতিতে নাম উঠে আসা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক কনসালট্যান্ট ডা. আনোয়ার জাবেদ বলেন, ‘সে সময় আমার কাছে ডা. শামীম আল মামুন এসেছিলেন কিছু তথ্যের জন্য। আমার নামটা অভিযোগে সে কারণেই এসেছে হয়তো।’

অনুসন্ধানের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অনুসন্ধানাধীন বিষয়ে কোনো মতামত করা ঠিক হবে না। আর অনুসন্ধান তো শেষ হয়ে যায়নি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত