Ajker Patrika

আলোচনায় হিজাব

শাহ নিসতার জাহান
Thumbnail image

হিজাব নিয়ে এ দেশে নানা সময় নানাভাবে কথা ওঠে। কথা নানা দেশেই ওঠে। তবে আমাদের দেশে এই আলোচনা হয় একটু অন্যভাবে। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান একটি রাষ্ট্র। প্রতিটি ধর্মেরই কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। ইসলামেও আছে। মুসলিম ধর্মের নারীরা সে অনুযায়ী শালীনতা বজায় রেখে চলাচল করবেন, তাই হিজাব-বোরকা চোখে পড়বে—এটাই স্বাভাবিক।

সাম্প্রতিক সময়ে হিজাব-বোরকার ব্যবহার বাড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাব পরিহিত মেয়ে ভরে গেছে, এমন কথাই আলোচনায় আসছে এবং এই আলোচনা করতে গিয়ে এমনও বলা হচ্ছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসা হয়ে গেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে বহু আলোচনা চলছে, বিশেষ করে হিজাব যে মৌলবাদী ধারণাকে আশ্রয় করে তৈরি, সে বিষয়ে আমরা অনেকেই বক্তব্য দিই। গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পরীক্ষা চলাকালে কানসহ মুখমণ্ডল খোলা রাখার প্রজ্ঞাপন দেওয়াকে কেন্দ্র করে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হওয়ায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

একজন শিক্ষক কিছুদিন আগে আলাপ প্রসঙ্গে জানালেন, একজন ছাত্রী তাঁর মেয়ের মতো। বাবা হিসেবে মেয়ের চেহারা তো দেখার অধিকার তাঁর আছে। আবার অনেকে নিরাপত্তার বিষয়কে এর সঙ্গে টেনে আনছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব বা বোরকা দেখলে অনেকেরই নাকি মনে হয় এটি মাদ্রাসার সমতুল্য, এখানে আর পড়াশোনার পরিবেশ নেই! অনেকে পঞ্চাশ-ষাটের (‘আধুনিক’ পোশাক পরিহিত) ছাত্রীদের ছবি সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরে তুলনা করছেন, আহা, আমরা কোথায় আছি এবং কীভাবে গোল্লায় যাচ্ছি! আরও বেদনাদায়ক হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ থেকে একবার এক ছাত্রীকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ, তাঁর মতো পোশাক পরে একটি ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আধুনিক’ একটি বিভাগে পড়া উচিত নয়।

যাঁরা পঞ্চাশ-ষাটের সময়ের তুলনা করছেন এখনকার সময়ে, তাঁদের জন্য বলছি, আচ্ছা, ওই সময়ে কাদের ঘরের মেয়েরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন? আপনি তখন যাঁদের দেখেছেন, তাঁরা সমাজের উঁচু ঘরের। নয় কি? সে সময় আমাদের কৃষকঘরের কতজন স্কুলে যেতেন? এখন কিন্তু তাঁদের ছেলেমেয়েরাই ভরিয়ে রেখেছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

তাঁদের কিংবা তাঁদের মা-বাবার মনে রয়েছে সাংঘাতিক ধর্মভীতি। আপনার-আমার ধর্ম না হলেও হয়তো চলে, আপনার-আমার যে বিশ্বাস, তাতে একটু ঘোল-দুধ-দই মেশালেও ক্ষতি নেই। কিন্তু তাঁর সমাজ-পরিবার তো ধর্মকে প্রথম সত্য বলে জানে। অজপাড়াগাঁয়ের সেই মানুষটি যদি জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মানে তাঁর ধর্মকে ত্যাগ করা, তাহলে কী ঘটতে পারে?

যদি জানেন আপনি তাঁর পর্দা কেড়ে নিচ্ছেন, কেমন হবে তাঁর মনের অবস্থা? তিনি হয়তো তাঁর সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কাছেপিঠে কোনো কলেজে পড়াবেন। তাতে সর্বনাশ ছাড়া কিচ্ছু হবে না; বরং একটি সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপনার সন্তান তো বিদেশে পড়বে, আরও ‘আধুনিক’ হওয়ার জন্য। কিন্তু এঁদের কী হবে?

বিদেশে পড়ার এবং পড়ানোর সময় আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু ভিন্ন। ফুল-ভেইল বোরকা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে আসতে-ঢুকতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। না, পরীক্ষায় বসতেও না। এই বোরকা নিয়ে কোনো রকম কটাক্ষ করার পরিণতিও সেখানে ভয়াবহ, বিশেষ করে কোনো শিক্ষক সেটি করলে খুব সমস্যায় পড়বেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছেড়ে কথা বলবে না। ঘটনা সামান্য হলে হয়তো ছাত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে রক্ষা পাবেন (শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করে দেওয়া তো বহু পরের ব্যাপার)।

একটি সমাজকে প্রথমে উঠে আসতে হয়, তারপর তাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা যায়। সে জায়গায় আমাদের পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে। আমাদের দেশে একটি ভালো শিক্ষিত শ্রেণি দরকার। সেটি কিন্তু তৈরি হয়নি। তাহলে আমাদের গ্রামের সলিমুদ্দির মেয়ে (যাঁর বাবা ‘ক’ লিখতে কলমও ভাঙতে পারেন না, আর মা স্কুল কী বস্তু, বোঝেন না), তাঁকে এক্ষুনি কোনো তত্ত্ব শেখানোর দরকার আছে কি? বরং তাঁকে আগে স্কুলমুখী করুন। তাঁকে আলোর মুখ দেখান। ‘সব গেল, সব গেল’ বলে ‘পুরোনোরা’ই চেঁচাচ্ছে না; আপনি তো আরও বেশি তা করছেন।

আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায় ফিরি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাংলা বিভাগের একজন খুব ডাকসাইটে অধ্যাপক কিন্তু মেয়েঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে কদিন আগে শাস্তি পেলেন (তিনি নিশ্চয়ই বাবার অধিকার নিয়ে মেয়েটির চেহারা দেখতে চাননি!)। অনেকে বলছেন তাঁকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে কত লঘু শাস্তি দেওয়া যায়, তার জন্য বহু লোক-লস্কর ছোটাছুটি করেছেন (আহা, একজন অপরাধীর কত বন্ধু!)। তাতে তাঁর উপকারও হয়েছে। আমাদের গণমাধ্যম অবশ্য সেটি খুব খেয়াল করেনি। এ দেশে কতজন শিক্ষক ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণের জন্য দায়ী, সে খবর আমাদের হাতে আছে কি? আর পরীক্ষার হলে কতজন শিক্ষার্থী আপনার অভিযোগে অভিযুক্ত? হয়তো একটিও নেই।

সব মিলিয়ে বলছি, সমস্যা কিন্তু ছাত্রীদের নিয়ে নয়; বরং শিক্ষকদের নিয়ে। আগে তো আমরা ঠিক হই, তারপর না হয় মা-বাবার দাবি নিয়ে ছাত্রীটির চেহারা দেখতে চাইব। হিজাব খুলবে নাকি থাকবে, সেটি তারাই ঠিক করতে পারবে, আপনার-আমার চেয়েও ভালো করে।

লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত