Ajker Patrika

নিমেষেই শেষ পরিবারটি

শাহীন রহমান, পাবনা
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২১, ১৩: ২৯
Thumbnail image

বাড়ির আঙিনায় কয়েকশ নারী-পুরুষ। সবার মধ্যে শোকের ছায়া। অনেকের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। বাড়ির মানুষ ও আত্মীয়স্বজনের বিলাপ, আহাজারি। এর মাঝে ঘরের বারান্দায় বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন আজমল মণ্ডলের বৃদ্ধ বাবা চান মিয়া (৬৩)। ছেলে, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনির লাশ দেখে তিনি শোকে পাথর হয়ে গেছেন। গতকাল রোববার সকালে ফুলপুর উপজেলার হাট পাগলা গ্রামে গিয়ে এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়।

দুর্ঘটনাকবলিত বাসের যাত্রী থাকলেও ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছেন রফিক মণ্ডল। কিন্তু কোল বদলে বাঁচা হলো না আট বছর বয়সী নাতনি মারিয়া বেগমের। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে নিহত শিশু মারিয়ার বাবা, মা, ছোট ভাই ও সম্পর্কে দাদা একই গাড়িতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের ফুলপুরে আসছিল। পথে বেপরোয়া গাড়ির চালকের খামখেয়ালিপনায় ঝরে গেল শিশু মারিয়ার পুরো পরিবার।

গত শনিবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চেলেরঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাম ট্রাকে যাত্রীবাহী বাস ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের চারজনসহ সাতজন নিহত হন। আহত হন আরও ৯ জন। নিহতদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই ৫ জন নিহত হয়। পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে ভর্তি করলে আরও দুজন মারা যান।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও ৮ বছরের শিশু মারিয়া বেঁচে ফেরা রফিক মণ্ডলের কোলে ছিল। সে তার মায়ের কোলে ফেরার কিছুক্ষণ পরই ঘটে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ির ডান পাশে বসেছিলেন মারিয়ার পরিবারের সবাই। দুর্ঘটনার আগে সিট পরিবর্তন করে রফিক মণ্ডল গাড়ির মাঝামাঝি বামপাশে এসে বসেন। তখন তার কোলেই ছিল নাতনি মারিয়া।

এভাবে কিছুটা পথ আসার পর সে মায়ের কোলে ফিরে যায়। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশালের চেলেরঘাট এলাকায় ঘটে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার পরও চালক দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়িটি নিয়েই ছুটতে থাকেন। আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে পালিয়ে যান তিনি। অথচ দুর্ঘটনার পরই বাসে বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা তাকে বাস থামানোর আকুতি জানালেও চালক শোনেনি।

দুর্ঘটনার পর সড়কে পড়ে থাকে আজমলের পরিবারের চার সদস্য ও আরও একজনের লাশ। তাঁর চাচা রফিক মণ্ডল আধা কিলোমিটার পেছনে এসে দেখেন তাঁদের পরিবারের চার সদস্যের একজনও বেঁচে নেই। দুর্ঘটনায় মা ফাতেমার কোলে থাকা আব্দুল্লাহ ছিটকে পড়লে তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও পড়ে যান মহাসড়কে। পাশের সিটে থাকা আজমলও তাঁর কোলে থাকা মারিয়াকে নিয়ে পড়ে যান রাস্তায়। এখন নিহত আজমলের পরিবারে রইল তাঁর বৃদ্ধ দুই বাবা-মা, এক ছোট ভাই ও বোন লাকি আক্তার।

রফিক মণ্ডল হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘এভাবে আমার ভাতিজা, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের দুই সন্তানের মৃত্যু দেখবো, তা কখনো ভাবিনি। আমি যদি সিট না পাল্টাতাম, তবে হয়তো আমিও মরে সড়কে পড়ে থাকতাম। আমাকে এক অছিলায় আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।’

আজমল মণ্ডলের ছোট ভাই আশিক মণ্ডল তাঁর পরিবারের চারজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন। নিহতরা হলেন ফুলপুর উপজেলার একই পরিবারের আজমল মণ্ডল হজু (৩০), তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম (২৮), ছেলে আব্দুল্লাহ মণ্ডল (৬) ও মেয়ে মারিয়া বেগম (৮)। এ ছাড়া ভালুকা উপজেলার নিশিন্দা এলাকার হেলেনা আক্তার (৪০), শেরপুরের নকলা উপজেলার নজরুল (৫৫) ও মিরাজ (৩৫) মারা যান।

ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন বলেন, বাসটি জব্দ করা হয়েছে। চালককে ধরার চেষ্টা চলছে। পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বেঁচে যাওয়া চাচা রফিক মণ্ডল এবং তাঁর শ্বশুর নজরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিন ধরেই তাঁরা মানিকগঞ্জ থেকে নিজের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। পরে গত শনিবার অসুস্থ মা-বাবাকে দেখার জন্য স্ত্রী ছেলে-মেয়ে এবং চাচাকে নিয়ে ফুলপুরের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন বাসে করে।

বাসটি ত্রিশাল এলাকার চেলেরঘাটে পৌঁছালে দুর্ঘটনায় পড়ে। পরে রাত ১১টার দিকে লাশ একটি পিকআপে করে ওই গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে কান্নার রোল পড়ে যায়। ভারী হয়ে ওঠে ওই এলাকার বাতাস।

বৃদ্ধ চান মিয়া লাশ দেখে ভেজা চোখে চালে ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। পাশে তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বাড়ির লোকজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে আহাজারি করছিলেন। শ্বশুর নজরুল ইসলাম জানান, রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্থানীয় হাট পাগলা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে গ্রামের গোরস্থানে তাঁদের দাফন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় নিহত হেলেনার স্বামী তাজুল ইসলাম বাদি হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা করেছেন। এতে অজ্ঞাতনামা দুজনকে আসামি করা হয়েছে। ত্রিশাল থানার ওসি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত