Ajker Patrika

বাংলার হাটে রুশ হাটুরে

জাহীদ রেজা নূর। রূপপুর (পাবনা) থেকে ফিরে
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১১: ০৭
বাংলার হাটে রুশ হাটুরে

গ্রিন সিটির সামনেই মো. রায়হানের ফলের দোকান। দোকান বলতে চারটি বাঁশ পুঁতে তার ওপর ছাউনি। ছাউনির নিচে চৌকি পেতে সাজানো হয়েছে ফল। ফলগুলোর নাম এখন বলছি না। কারণ, এইমাত্র আমরা তাঁকে প্রশ্ন করেছি, তিনি যখন রাশানদের কাছে ফল বিক্রি করেন, তখন কোন ভাষায় কথা বলেন।

উত্তরে রায়হান বললেন, ‘কেন, রাশান ভাষায়!’

–আপনার সামনে যে ফলগুলো আছে, সেগুলোর নাম রাশান ভাষায় বলেন তো।

-এটা আপেলসিন (মাল্টা), এটা মান্দারিন (কমলা), এটা গ্রানাদ (ডালিম), পিতাখায়া (ড্রাগন ফল), ভিনাগ্রাদ (আঙুর), ইয়াবলাকা (আপেল)।

-আ পা চোম ভিনাগ্রাদ? (আঙুরের কেজি কত?)।

-দুয়েস্তি পিৎদিসাত।

পাশ থেকেই একটা চিকন কণ্ঠ ভেসে ওঠে, ‘দুয়েস্তি না, দ্ভেসতি।’ যে কিশোরের কণ্ঠ, তার সঙ্গে আগেই কথা হয়েছে। ও এরই মধ্যে একেবারে রাশানদের উচ্চারণে রুশ শব্দ বলে। তার নাম আরসালিন বিশ্বাস।

- আ আপেলসিন?

-আপেলসিন স্তো সিয়েমদিসাত কিলাগ্রাম। (মাল্টার কেজি ১৭০ টাকা।)

-মান্দারিন দ্ভেস্তি দ্ভাৎসেত। (কমলা ২২০ টাকা)

-আনানাস। আদিন সিয়েমদিসাত। (আনারস এক সত্তর।)

আপত্তি করে কিশোর। বলে ওঠে, ‘নিয়েত। আদিন শ্তুক সিয়েমদিসাত।’ (না, একটার দাম সত্তর টাকা।)

ছেলেটা যে দারুণভাবে রুশ ভাষা শিখেছে, তা ওই ‘শ্তুক’ উচ্চারণ থেকে বোঝা যায়। শ্তুক মানে হলো ‘টা’। যার অর্থ ‘একটা আনারস।’ ব্যাকরণে ভুল নেই।

এবার প্রসঙ্গান্তরে যাই।

-আপনারা ওদের কাছ থেকে দাম বেশি নেন?

-না। বাজারদরেই বিক্রি করি। বেশি দাম নিই না।

-রাশানরা ফল পছন্দ করে?

-খুব পছন্দ করে।

-রায়হান সাহেব, ভালো লাগল আপনার সঙ্গে কথা বলে।

-স্পাসিবা (ধন্যবাদ)!

মো. রায়হান বুঝিয়ে দিলেন, বিদায়ের সময় ধন্যবাদটাও তিনি রুশ ভাষায় দেন।

‘ইনটেন্স’ নামের একটি বনেদি পোশাকের দোকানে ঢুকলাম আমরা। পরিপাটি সাজানো আছে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই। বিদেশিদের যা দরকারি পোশাক, তা রয়েছে। ‘বাংলাদেশ কোঝা’ লেখা আছে, অর্থাৎ বাংলাদেশ লেদার। রাশানরা যেন বুঝতে পারে। মেহেদী হাসান মামুন এই দোকানে কাজ করছেন দুই মাস। তাঁকেই জিজ্ঞেস করি, কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলবেন?’

মেহেদী বললেন, ‘প্রথমে ভাষা বুঝতাম না। নতুন ছিল সবকিছু। পরে ‘হাই’ না বলে বলি ‘প্রিভেত’। আমরা প্রিভেত বললে তারা বলে ‘স্দারোভ’। পছন্দ হলে বলে, ‘স্কোলকা’। মানে ‘কত?’ ওদের ভাষায় তখন উত্তর দিই আমরা। ধরুন কোনো প্রডাক্টের দাম হলো ১ হাজার ৬৫০, আমরা বলি তিসিচা শিৎসোত পিদ্দিসাত। এখন সংখ্যা সব মুখস্থ হয়ে গেছে।’

ঝুলিয়ে রাখা পোশাকগুলোর দাম ঠিকঠাক জানে কি না, তা পরখ করি। কোনো ভুল নেই। সুয়েতার (সোয়েটার)। কুর্তকা (জ্যাকেট)। শার্ট হচ্ছে রুবাশকা, প্যান্ট শ্তানি। ক্যাপ হচ্ছে কেপকা। ব্যাগ হচ্ছে সুমকা। বেল্ট হলো রেমেন।

-আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে?

-ওরা বন্ধুর মতো কথা বলে। পরিবার নিয়ে কথা বলে। দেশে পরিবার রেখে এসেছে বলে দুঃখ করে।

-বেশি দাম চান না তো?’

-না না। বার ট্যাগ থাকে। ফিক্স রেট। বাড়তি নয়।’

-আরেকটি প্রশ্ন। স্থানীয় মানুষ আপনি, এখানে এত বড় একটা প্রজেক্ট আসার পর জীবনযাত্রার মানে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি?

-যেসব মানুষ বেকার ছিল বা যাদের অর্থ কম ছিল, তারা লাভবান হয়েছে। পারমাণবিক প্রকল্পেই কাজ পাচ্ছে। ব্যবসা করছে যারা, তারাও খুব ভালো আয় করছে। একটা পরিবর্তন তো এসেছেই।

সবজির বাজারে গেলে শুনতে পাই ‘বন্দু, বন্দু...’ বলতে বলতে এক রাশান এগিয়ে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধ ডিমবিক্রেতার দিকে। তিনি ৩০টা ডিম নেবেন। মনে পড়ে গেল, রাশিয়ায় এভাবে ৩০টা ডিমই কিনে নিত সবাই। একটা কাগজের বাক্স ছিল, যাতে ৩০টা খোপ ছিল। এ কারণেই দুই বা তিন ডজন না কিনে তিনি ৩০টা ডিম কিনছেন। এক পলিথিনে ৩০টা ডিম ঢোকাতে দেখে তিনি রুশ ভাষায় বললেন, একটায় দিলে ডিম ভেঙে যাবে, ১৫টা করে দুটো প্যাকেট তৈরি করো।’ ‘বন্দু’কে বুঝিয়ে বললে তিনি সেভাবেই ডিম প্যাকেট করে দেন।

মরিচ কিনলেন। বেছে বেছে লালগুলো। কৌতূহল মেটালেন এই কথা বলে, ‘আমি ঝাল খেতে পারি না। ম্যারিনেট করে তারপর মরিচ খাব।’

-আমাদের দেশটা কেমন লাগছে আপনার?’

-জানেন, প্রথম যখন এসেছি, তখন বুঝতে পারছিলাম না কিছু। এরপর ধীরে ধীরে দেখলাম, পরিশ্রমী জাতি। তিন বছর আছি এখানে। এখানকার মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এর আগেই ইউক্রাইনের খারকভে যখন পড়াশোনা করেছি, তখন বাংলাদেশি ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। আমি পাস করেছি ১৯৮৬ সালে।

-কোন ধরনের খাবার খান?

-সব ধরনের। আপনাদের এখানে বেগুন আছে। এখানে আপেলগুলো পাথরের মতো। ভালো লাগে না। কিন্তু আম, লিচু, পেঁপে খুব ভালো। গরুর মাংস পছন্দ করি, বাজার থেকে কিনে খাই। মাছও খুব ভালো।

-আপনার নাম তো জানা হলো না।

-আমার নাম আলেক্সান্দর। বন্দু, এবার যেতে হবে।

আলেক্সান্দরের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে আরসালিন। এবার ওকে নিয়ে পড়ি আমরা। ওর রুশ ভাষাজ্ঞানে আমরা মুগ্ধ।

-আরসালিন, তুমি কীভাবে রুশ ভাষা শিখলে?

-হালকা-পাতলা জানতাম। তারপর রাশিয়ানদের সঙ্গে কথা বলে।

-কীভাবে হালকা-পাতলা জানতে?

-নেট দেখে।

-উচ্চারণ ঠিক করলে কী করে?

-নেটে উচ্চারণ শুনেছি। রাশানদের কাছ থেকেও শুনেছি।

এরপর গড়গড় করে সব ফল আর সবজির নাম রাশানে বলে যেতে থাকে আরসালিন। উচ্চারণ একটাও ভুল হয় না।

গ্রিন সিটির আশপাশে যেসব বাঙালি অর্থনৈতিক কারণে এসে ঠাঁই নিয়েছেন, তাঁরা নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য। এই হলো টিকে থাকার প্রতিযোগিতা। যে ভালো রুশ জানবে, সে এগিয়ে থাকবে। আর এ জন্যই মাঝে মাঝেই কোনো এক সবজি বা ফলের দোকান থেকে ভেসে আসে ‘দাভাই, দাভাই’ শব্দ। ‘দাভাই’ শব্দের নির্দিষ্ট কোনো মানে নেই। তবে কখনো তা ‘এসো’, কখনো, ‘ঠিক আছে’ ইত্যাদি।

এখানে এই নতুন হাটের কাছে দোকানের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা মানুষদের দেখে মনে হয়, চেহারা-সুরতে এরা বাঙালি, কিন্তু বাঁচার প্রতিযোগিতায় নেমে ওরা আধখানা হৃদয় আপাতত রুশদের ধার দিয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আরপিও সংশোধন অনুমোদন

এলাকার খবর
Loading...