Ajker Patrika

তারুণ্য ও বাঙালির জয়

অজয় দাশগুপ্ত
তারুণ্য ও বাঙালির জয়

বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে বসবাস আমাদের। হাজার হাজার মাইল দূরের দেশগুলোয় বসবাসরত বাংলাদেশিরা কীভাবে এসব দেশ ও সমাজকে আপন করে নিয়েছে, তা না দেখলে বোঝা অসম্ভব। এই আপন করাটা তার দরকার, সঙ্গে তাদের বসবাস ও জীবনকে নিরাপদ রাখা। একইভাবে আমাদের শিকড় আছে। আমরা এমন কোনো জাতিসত্তা না, যাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়। বাঙালির পরিচয় তার কৃষ্টি, ইতিহাস আর স্বাধীনতায়। সবচেয়ে বড় জায়গাটা কী জানেন? আমাদের ভাষা আন্দোলন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন না হলে বাংলা ভাষা তার মর্যাদা লাভ করত না। আর সেটা না হলে আজকের বাংলাদেশও হতো না। 

আসি সিডনি প্রসঙ্গে। আমাদের প্রজন্ম যখন অভিবাসী হয়ে এসেছিলাম, কিছুই ছিল না। না বইয়ের বাজার, না শহীদ মিনার, না কোনো ভাষাভিত্তিক বড় বড় আয়োজন। সেই অচলায়তন ভেঙে এখন আমাদের একাধিক মিনার আছে। মূল ও প্রথম যেটি তার নাম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ। একুশে বইমেলা ধীরে ধীরে একুশে একাডেমি হলো। তারাই দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে এই স্মৃতিসৌধ। সেই সময়কালে আমি নিজেদের ঐক্য আর সংহতি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। কথায় কথায় বিভাজনের সমাজ সেসময় এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। কেন? একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ হবে বলে। মানুষের ভালোবাসার কথাও বলতে হবে। বাঙালি বিদেশের মাটিতে দেশপ্রেমী। এটা তার গর্ব। সেই গর্বের এই প্রতীক আজ আমাদের সবার অহংকার।

কী কী হয় এখানে? সকালে প্রভাতফেরি, রাত ১২টা ১ মিনিটে ফুল দেওয়া, পরে গান-কবিতা, ছবি আঁকা সব হয়। আছে বইয়ের পসরা। একুশে একাডেমি, মুক্তমঞ্চ, প্রশান্তিকা, মেরুদণ্ড এমন সব নামের বইয়ের দোকানে ভিড় করেন পাঠক। দেদার বই বিক্রি আর নবীন লেখকদের আগমনে প্রতিবছর ফুলেফেঁপে এটি এখন মহিরুহ।

ভাববেন না এখানেই শেষ। আমাদের ভাষা, আমাদের সংগ্রামের আরেকটা দিক এখনো আবিষ্কার হয়নি। সেটি হচ্ছে এ দেশে বড় হয়ে ওঠা প্রজন্মের কৃতিত্ব। এরা কী করে শুনলে অবাক হবেন। এদের কেউ কবিতা লেখে, কেউ গান গায়, কেউ অভিনয় করে, কেউ নির্দেশনা দেয়। আমার পুত্র নিজেই একজন সফল অভিনেতা ও নির্দেশক। তার পরের প্রজন্মও এখন সামনের কাতারে। মুগ্ধ হয়ে দেখি আর ভাবি, এভাবেই বিশ্বজয় করে চলেছি আমরা। 

একুশের সঙ্গে বিশ্ব বাঙালির যোগ শুধু বাংলা ভাষায় সীমাবদ্ধ নেই। একুশে সেটা চায়ও না। তার দরকার অধিক বিস্তার। কিছুদিন আগে অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর এসেছিলেন ঢাকায়। একটি অনুষ্ঠানে দেখলাম তাঁকে কেউ একজন বাংলায় কথা বলার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শর্মিলা ঠাকুর বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি বাংলা জানেন এবং এটা সবাই জানে। তবে আন্তর্জাতিক একটি আয়োজনে আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিতে কথা বলা ন্যায়সংগত। আপনি যদি বড় পরিসরে ভাবেন কথাটা সত্য। আমাদের সময় হয়েছে নিজেদের ভাষাকে আন্তর্জাতিক করে তোলার। সে কারণে ইংরেজি, ফরাসি, আরবি এমন সব ভাষার দরকারও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। স্প্যানিশের মতো ভাষা সাহিত্য বিরল। তাদের দিকে মুখ ফেরানোতে আছে আনন্দ। আগেকার জমানার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ছিলেন। তাঁদের কারণেই আমরা বাংলা ভাষার সঙ্গে সেসব ভাষার যোগ খুঁজে পেয়েছি। পেয়েছি সুললিত সুখপাঠ্য সাহিত্যসম্ভার। 

কদিন আগেই আমার গায়ক বন্ধু দম্পতি মনজুর হামিদ কচি ও নাসরিন হামিদের একমাত্র কন্যা মুনাসিব হামিদের একটি কাজ আমাকে আপ্লুত করেছে। মেয়েটিকে আমি কথা না ফোটার শৈশব থেকে চিনি। সেই মুনাসিব এখন ছবির কারিগর। এখানকার প্রখ্যাত টিভি চ্যানেল আর সরকারি অনুদানে তারা কয়েকজন মিলে স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। সিডনির পশ্চিম নিয়ে নির্মিত ওয়েসটানার নামের এ চিত্রকল্পটি আমাদের জন্য আশা ও সুখের খবর। ওই যে বলছিলাম ধীরে ধীরে আমাদের যাত্রা ও গন্তব্য তার জায়গা খুঁজে নিয়েছে, এটা তার এক বিশাল উদাহরণ। ছবিটির বিস্তারিত দেখতে হলে আপনি তাদের ওয়েব পেজে গিয়ে পাবেন। যেমন পাবেন হিয়ার আউট ওয়েস্ট। এসব বাংলাদেশি নির্মাতা মোটামুটি এটা নিশ্চিত করছেন, সময় আমাদের।

যাঁরা প্রবাসের বাঙালিকে দূরের কেউ মনে করেন বা ভাবেন, এরা পর হয়ে গেছে, তাঁরা বড় ধরনের ভ্রান্তির ভেতর বসবাস করেন। আজকাল গ্লোবাল ভিলেজের যুগ। এই আধুনিক গ্রামে আমরা দুনিয়াজোড়া সবার প্রতিবেশী। যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন আর অগ্রযাত্রার কথা শুনি, তার সঙ্গে এর যোগ নিবিড়। সিডনি বলে নয়, দুনিয়াজোড়া বাঙালির বিস্তার এখন সব দেশে, সব বড় বড় শহরে। হয়তো আপনি বেড়াতে এসেছেন, কেউ আপনাকে ড্রাইভ করে নিয়ে চলেছে অনেক দূরের কোথাও, দেখবেন সবুজ মাঠ, আকাশছোঁয়া পাহাড় পেরিয়ে যে শহরে ঢুকেছেন, তার দোকানের সাইনবোর্ডটিতে কোথাও বাংলা লেখা।

গত সপ্তাহে আমরা গিয়েছিলাম ক্রেইনস নামের এক বিখ্যাত পর্যটন শহরে। সিডনি থেকে তিন ঘণ্টার উড়াল। অনেক দূরের এ জায়গাটি নিয়ে গল্প আছে অনেক। তার ভেতরে একটি হলো, মানুষ যখন চন্দ্র বিজয়ে নেমেছিল, তখন তারা মহাশূন্য থেকে চীনের প্রাচীরের পাশাপাশি এ জায়গাটির সমুদ্রে থাকা প্রবাল দ্বীপ দেখেছিল—এমন মিথও চালু আছে। নয়নাভিরাম এই এলাকার পর্যটনে কুমির দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। কুমিরে কুমিরে সয়লাব লেগুন বা সবুজাভ জলাশয়ে বোট বা ছোট জাহাজে ভ্রমণ। তার আগে নিজেকে চাঙা করতে গিয়ে এক কাপ চা পানের সময় পরিচয় হলো নিকের সঙ্গে। নীল টি-শার্ট পরা নিক ছিলেন আর দশজন ট্যুরিস্টের মতো কেউ একজন। কেন তাঁর সঙ্গে আলাপ? তাঁর সেই টি-শার্টটির পেছনে অনেকগুলো ভাষায় কিছু একটা লেখা ছিল। হঠাৎ দেখি মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে বাংলা ভাষা। তাঁর টি-শার্টের পেছনে লেখা ‘জীবন বাঁচাতে আকাশপথে’—কক্সবাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত এক ভিন্ন গল্প। যা পরে বলার ইচ্ছে থাকল।

আসল কথা, এই বাংলা ভাষা ও দেশ বাংলাদেশ এখন সর্বত্রগামী এক উজ্জ্বল নাম। সেটা নিক হোক আর তরুণী মুনাসিব হোক, আমাদের ভাষা আর আমাদের পরিচয়কে বড় করে তুলছে এরা। একুশের সঙ্গে যোগ না থাকলে কি তা হতো? যে ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছিল, তার এমন জয় ইতিহাসেরই এক বিচার। আমাদের দেশ ও জাতির অহংকার।

লেখক: অজয় দাশগুপ্ত 
অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদিকে হত্যাচেষ্টায় জড়িত মোটরসাইকেল শনাক্ত, মালিক সন্দেহে একজন আটক

হাদির মস্তিষ্কের অবস্থা ‘খুবই খারাপ’, এখনো আশঙ্কাজনক: চিকিৎসক

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: সন্দেহভাজন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব জব্দ

সুদানে নিহত ও আহত শান্তিরক্ষীদের পরিচয় জানাল আইএসপিআর

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

এলাকার খবর
Loading...