ড. সৈয়দ ইজাজ আহসান
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গবেষণাকে অনেকটা বিলাসিতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। অন্য একটা কারণও খুবই স্পষ্ট, আর তা হলো আর্থিক সংগতি। উন্নত দেশগুলো প্রতিবছর শত সহস্র কোটি ডলার ব্যয় করে গবেষণা খাতে। কিন্তু কেন? কেননা, গবেষণার মাধ্যমেই পৃথিবী এগিয়ে চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালির ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে মহাকাশ যান ও কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ পর্যন্ত—সব ক্ষেত্রেই রয়েছে গবেষণার অবদান। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি চীনের উত্থানের পেছনেও রয়েছে গবেষণার অবদান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের ঈর্ষণীয় উন্নয়ন নিবিড় গবেষণারই ফল। চীন কিছু কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে গবেষণার অনেক ক্ষেত্রে। যে দেশ যত উন্নত, সেই দেশের গবেষণায় বিনিয়োগ তত বেশি।
গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। এই নতুন জ্ঞান প্রয়োগ করে বর্তমান অবস্থা থেকে অধিকতর উন্নত পর্যায়ে প্রবেশ করা। কৃষি, চিকিৎসাশাস্ত্র, যোগাযোগ, প্রযুক্তি—প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণা তার প্রত্যাশিত অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে এখানে আর একটা প্রশ্ন দেখা দেয়, এই গবেষণা ও উন্নতি কার জন্য এবং দ্বিতীয়ত, গবেষণার উদ্দেশ্য মানবসভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে কি না। উদাহরণস্বরূপ, পরমাণু গবেষণা একটা বিশাল দিগন্ত খুলে দিয়েছে মানবসভ্যতার জন্য। পরমাণু শক্তি উৎপাদন থেকে কৃষি, শিল্প, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিটি ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছে পরমাণু গবেষণা। কিন্তু এই পরমাণু গবেষণা দ্বারা আবার পরমাণু বোমার ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে পৃথিবীকে নিয়ে যাওয়া যায় এক অন্ধকার জগতে। হিরোশিমা-নাগাসাকি তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
আর একটা বিষয় হলো, কার উপকারে এই গবেষণার ফল ব্যবহৃত হবে। এ জন্য বলছি যে অনেক দেশে, বিশেষ করে প্রাচীন মিসরে বিজ্ঞানে অনেক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। কিন্তু তার সবই ছিল রাজা-বাদশাহ ও তাঁদের অনুচরদের জন্য। মিসরের পিরামিড, ফেরাউনের মমি কিংবা আগ্রার তাজমহল—এর কোনোটাই সাধারণ জনগণের কল্যাণের জন্য নির্মিত হয়নি। আর তাই রাজা-বাদশাহদের তিরধানের সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রগতি বা অগ্রগতি যা-ই বলি না কেন, সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে। গবেষণার আর একটি বিষয় হলো, এটা ধাপে ধাপে উৎকর্ষ লাভ করে। কোনো একপর্যায়ে যদি কোনো ছেদ পড়ে, তবে পরবর্তী ধাপে প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়ে অথবা একেবারেই স্থবির হয়ে যেতে পারে। যেমনটা পিরামিড মমি বা সমসাময়িক অন্যান্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে হয়। শোনা যায়, তাজমহল নির্মাতা স্থপতিদের নাকি হাত কেটে ফেলা হয়েছিল, যাতে তাঁরা এ রকম স্থাপনা আর একটা তৈরি করতে না পারেন। এভাবেই বিজ্ঞান ও গবেষণার অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু পরবর্তীকালে দেশে দেশে বিজ্ঞান ও গবেষণার ফসল সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে খুব সহজে। আর দ্বিতীয়ত, ধীরে ধীরে বিশ্ববাণিজ্যের সুবিশাল ব্যাপ্তি গবেষণার ফলকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য আরও অবারিত করে দিয়েছে। এ কারণে যেসব দেশ গবেষণায় যত বেশি বিনিয়োগ করেছে, ফলস্বরূপ তারাই তত উন্নতি লাভ করতে পেরেছে। সুতরাং যেকোনো দেশ উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করতে চাইলে তাকে অবশ্যই গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে।
এবারে আসা যাক আমাদের দেশের কথায়। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এখন সেভাবে গবেষণায় বিনিয়োগ হয়নি বা হচ্ছে না বলা চলে। তবে একটা ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে, তা হলো কৃষি। এর ফলও খুবই পরিষ্কার সবার কাছে। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশে যেখানে ১৮ কোটি লোকের বাস, সেখানে খাদ্য ঘাটতি নেই। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু কৃষি গবেষণায় অভাবনীয় সাফল্যের জন্য। এর সঙ্গে মৎস্য, পশুপালন এবং ফলমূল, শাকসবজির উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। কৃষি গবেষকদের অক্লান্ত নিষ্ঠা ও শ্রম বাংলাদেশকে খাদ্যনিরাপত্তা দান করেছে, যা কিনা আফ্রিকার অনেক দেশ বিপুল চাষযোগ্য ভূমি থাকা সত্ত্বেও নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গবেষণা যে হয়নি তা নয়; তবে তা উল্লেখযোগ্য বা যথেষ্ট নয়, তা বলাই বাহুল্য। প্রযুক্তি, চিকিৎসা, উৎপাদনব্যবস্থা, সামুদ্রিক ও খনিজসম্পদ আহরণ এবং বিশেষ করে বাজার ও বিপণন ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে গবেষণায় বিনিয়োগ এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে বহুদূর।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি বাংলাদেশে প্রতিভাবান গবেষকের অভাব? তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী জুট জিনোম গবেষণায় বিশ্বব্যাপী সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এ ছাড়া গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশি গবেষকেরা দেশে-বিদেশে যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্ষেত্র চিহ্নিত করে গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে। আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে বাজার এখন বিশ্ববাজারে পরিণত হয়েছে।
এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিশ্ববাজারকে করে তুলেছে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। অন্যদিকে বিশ্ববাজার অবারিত করেছে অপার সম্ভাবনা। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার সীমাবদ্ধতা উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা এনে দেয়। বিশ্ববাজারে প্রবেশের সুযোগ এই সীমাবদ্ধতা দূর করে দিয়েছে দেশগুলোর জন্য। বর্তমান বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়া দেশগুলো বিশ্বায়নের এই প্রক্রিয়াকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগিয়েছে চীন। বিশ্ববাজার দখলের মধ্য দিয়ে চীন অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর দেশগুলোর উন্নতি নির্ভর করে রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর। যে যত বেশি রপ্তানি করতে পারবে, তার উন্নতি তত দ্রুত হবে—এটাই স্বাভাবিক। এই রপ্তানির ওপর কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্যের ভারসাম্য— সবই একান্তভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করতে গেলে বিশ্ববাজারে সুবিধাজনক জায়গা করে নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ এই অর্থে যে এখানে কৃষি, শিল্প, পর্যটন, খনিজ ও সমুদ্রসম্পদ—সব ক্ষেত্রেই অনেক সম্ভাবনা বিরাজমান। সেই সঙ্গে রয়েছে বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তি। কিন্তু এই সম্ভাবনাগুলো কি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে? হলে সম্ভবত বাংলাদেশের অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়া বা মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যেত। অন্যান্য দেশে গবেষণার কেন্দ্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমাদের দেশে এর বিপরীত। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণার সুযোগ খুবই সীমিত। যেহেতু এই গবেষণা খুব কম গুরুত্ব পায়, তাই আর্থিক বরাদ্দও কম। সরকারিভাবে না পেলে বেসরকারিভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সহজেই অর্থ সংস্থান করা যেত।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আয়ের একটা অংশ করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি হিসেবে ব্যয় করে প্রতিবছর। দেখা যায় প্রতিষ্ঠানগুলো এই অর্থ হাসপাতাল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করে, যা কিনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা, ব্যবসায়িকভাবেও এগুলো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যদি এই অর্থের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ গবেষণার কাজে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকত, তবে গবেষণায় অন্তত আর্থিক সমস্যা থাকত না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর গবেষণার একটা বিরাট অংশ এভাবেই আসে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে বাজার এবং পণ্য উন্নয়নের গবেষণালব্ধ ফল তাদের ব্যবসায়িক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে।
আমরা যদি আমাদের আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব, আমাদের রপ্তানি বাজার শুধু কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ; বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ। আবার আমরা যে পণ্যগুলো রপ্তানি করি, সেগুলোও গার্মেন্টস ও এ-জাতীয় পণ্য। অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি তো আছেই, যেমন কোভিড-১৯। এর ফলে পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা কী হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি।
সুতরাং বাজার সম্প্রসারণ, পণ্য বহুমুখীকরণ ও প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করতে হলে প্রয়োজন গবেষণায় বিনিয়োগ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য যে গবেষণার প্রয়োজন, তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং নীতিনির্ধারকদের গবেষণার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে সক্রিয়ভাবে। তবে গবেষণা হতে হবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক, মানসম্পন্ন ও প্রায়োগিক, যা দেশের কাজে আসবে সার্থকভাবে। আশা করি, গবেষণায় বিনিয়োগ দেশকে উন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত করবে অদূর ভবিষ্যতে।
ড. সৈয়দ ইজাজ আহসান, সিনিয়র ফ্যাকাল্টি, ডারল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গবেষণাকে অনেকটা বিলাসিতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। অন্য একটা কারণও খুবই স্পষ্ট, আর তা হলো আর্থিক সংগতি। উন্নত দেশগুলো প্রতিবছর শত সহস্র কোটি ডলার ব্যয় করে গবেষণা খাতে। কিন্তু কেন? কেননা, গবেষণার মাধ্যমেই পৃথিবী এগিয়ে চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালির ব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে মহাকাশ যান ও কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ পর্যন্ত—সব ক্ষেত্রেই রয়েছে গবেষণার অবদান। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি চীনের উত্থানের পেছনেও রয়েছে গবেষণার অবদান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের ঈর্ষণীয় উন্নয়ন নিবিড় গবেষণারই ফল। চীন কিছু কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে গবেষণার অনেক ক্ষেত্রে। যে দেশ যত উন্নত, সেই দেশের গবেষণায় বিনিয়োগ তত বেশি।
গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। এই নতুন জ্ঞান প্রয়োগ করে বর্তমান অবস্থা থেকে অধিকতর উন্নত পর্যায়ে প্রবেশ করা। কৃষি, চিকিৎসাশাস্ত্র, যোগাযোগ, প্রযুক্তি—প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণা তার প্রত্যাশিত অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে এখানে আর একটা প্রশ্ন দেখা দেয়, এই গবেষণা ও উন্নতি কার জন্য এবং দ্বিতীয়ত, গবেষণার উদ্দেশ্য মানবসভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে কি না। উদাহরণস্বরূপ, পরমাণু গবেষণা একটা বিশাল দিগন্ত খুলে দিয়েছে মানবসভ্যতার জন্য। পরমাণু শক্তি উৎপাদন থেকে কৃষি, শিল্প, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিটি ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছে পরমাণু গবেষণা। কিন্তু এই পরমাণু গবেষণা দ্বারা আবার পরমাণু বোমার ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে পৃথিবীকে নিয়ে যাওয়া যায় এক অন্ধকার জগতে। হিরোশিমা-নাগাসাকি তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
আর একটা বিষয় হলো, কার উপকারে এই গবেষণার ফল ব্যবহৃত হবে। এ জন্য বলছি যে অনেক দেশে, বিশেষ করে প্রাচীন মিসরে বিজ্ঞানে অনেক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। কিন্তু তার সবই ছিল রাজা-বাদশাহ ও তাঁদের অনুচরদের জন্য। মিসরের পিরামিড, ফেরাউনের মমি কিংবা আগ্রার তাজমহল—এর কোনোটাই সাধারণ জনগণের কল্যাণের জন্য নির্মিত হয়নি। আর তাই রাজা-বাদশাহদের তিরধানের সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রগতি বা অগ্রগতি যা-ই বলি না কেন, সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে। গবেষণার আর একটি বিষয় হলো, এটা ধাপে ধাপে উৎকর্ষ লাভ করে। কোনো একপর্যায়ে যদি কোনো ছেদ পড়ে, তবে পরবর্তী ধাপে প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়ে অথবা একেবারেই স্থবির হয়ে যেতে পারে। যেমনটা পিরামিড মমি বা সমসাময়িক অন্যান্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে হয়। শোনা যায়, তাজমহল নির্মাতা স্থপতিদের নাকি হাত কেটে ফেলা হয়েছিল, যাতে তাঁরা এ রকম স্থাপনা আর একটা তৈরি করতে না পারেন। এভাবেই বিজ্ঞান ও গবেষণার অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু পরবর্তীকালে দেশে দেশে বিজ্ঞান ও গবেষণার ফসল সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে খুব সহজে। আর দ্বিতীয়ত, ধীরে ধীরে বিশ্ববাণিজ্যের সুবিশাল ব্যাপ্তি গবেষণার ফলকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য আরও অবারিত করে দিয়েছে। এ কারণে যেসব দেশ গবেষণায় যত বেশি বিনিয়োগ করেছে, ফলস্বরূপ তারাই তত উন্নতি লাভ করতে পেরেছে। সুতরাং যেকোনো দেশ উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করতে চাইলে তাকে অবশ্যই গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে।
এবারে আসা যাক আমাদের দেশের কথায়। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এখন সেভাবে গবেষণায় বিনিয়োগ হয়নি বা হচ্ছে না বলা চলে। তবে একটা ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে, তা হলো কৃষি। এর ফলও খুবই পরিষ্কার সবার কাছে। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশে যেখানে ১৮ কোটি লোকের বাস, সেখানে খাদ্য ঘাটতি নেই। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু কৃষি গবেষণায় অভাবনীয় সাফল্যের জন্য। এর সঙ্গে মৎস্য, পশুপালন এবং ফলমূল, শাকসবজির উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। কৃষি গবেষকদের অক্লান্ত নিষ্ঠা ও শ্রম বাংলাদেশকে খাদ্যনিরাপত্তা দান করেছে, যা কিনা আফ্রিকার অনেক দেশ বিপুল চাষযোগ্য ভূমি থাকা সত্ত্বেও নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গবেষণা যে হয়নি তা নয়; তবে তা উল্লেখযোগ্য বা যথেষ্ট নয়, তা বলাই বাহুল্য। প্রযুক্তি, চিকিৎসা, উৎপাদনব্যবস্থা, সামুদ্রিক ও খনিজসম্পদ আহরণ এবং বিশেষ করে বাজার ও বিপণন ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে গবেষণায় বিনিয়োগ এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে বহুদূর।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি বাংলাদেশে প্রতিভাবান গবেষকের অভাব? তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী জুট জিনোম গবেষণায় বিশ্বব্যাপী সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এ ছাড়া গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশি গবেষকেরা দেশে-বিদেশে যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্ষেত্র চিহ্নিত করে গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে। আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে বাজার এখন বিশ্ববাজারে পরিণত হয়েছে।
এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিশ্ববাজারকে করে তুলেছে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। অন্যদিকে বিশ্ববাজার অবারিত করেছে অপার সম্ভাবনা। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার সীমাবদ্ধতা উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা এনে দেয়। বিশ্ববাজারে প্রবেশের সুযোগ এই সীমাবদ্ধতা দূর করে দিয়েছে দেশগুলোর জন্য। বর্তমান বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়া দেশগুলো বিশ্বায়নের এই প্রক্রিয়াকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগিয়েছে চীন। বিশ্ববাজার দখলের মধ্য দিয়ে চীন অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর দেশগুলোর উন্নতি নির্ভর করে রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর। যে যত বেশি রপ্তানি করতে পারবে, তার উন্নতি তত দ্রুত হবে—এটাই স্বাভাবিক। এই রপ্তানির ওপর কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্যের ভারসাম্য— সবই একান্তভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করতে গেলে বিশ্ববাজারে সুবিধাজনক জায়গা করে নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ এই অর্থে যে এখানে কৃষি, শিল্প, পর্যটন, খনিজ ও সমুদ্রসম্পদ—সব ক্ষেত্রেই অনেক সম্ভাবনা বিরাজমান। সেই সঙ্গে রয়েছে বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তি। কিন্তু এই সম্ভাবনাগুলো কি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে? হলে সম্ভবত বাংলাদেশের অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়া বা মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যেত। অন্যান্য দেশে গবেষণার কেন্দ্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমাদের দেশে এর বিপরীত। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণার সুযোগ খুবই সীমিত। যেহেতু এই গবেষণা খুব কম গুরুত্ব পায়, তাই আর্থিক বরাদ্দও কম। সরকারিভাবে না পেলে বেসরকারিভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সহজেই অর্থ সংস্থান করা যেত।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আয়ের একটা অংশ করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি হিসেবে ব্যয় করে প্রতিবছর। দেখা যায় প্রতিষ্ঠানগুলো এই অর্থ হাসপাতাল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করে, যা কিনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা, ব্যবসায়িকভাবেও এগুলো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যদি এই অর্থের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ গবেষণার কাজে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকত, তবে গবেষণায় অন্তত আর্থিক সমস্যা থাকত না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর গবেষণার একটা বিরাট অংশ এভাবেই আসে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে বাজার এবং পণ্য উন্নয়নের গবেষণালব্ধ ফল তাদের ব্যবসায়িক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে।
আমরা যদি আমাদের আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব, আমাদের রপ্তানি বাজার শুধু কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ; বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ। আবার আমরা যে পণ্যগুলো রপ্তানি করি, সেগুলোও গার্মেন্টস ও এ-জাতীয় পণ্য। অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি তো আছেই, যেমন কোভিড-১৯। এর ফলে পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা কী হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি।
সুতরাং বাজার সম্প্রসারণ, পণ্য বহুমুখীকরণ ও প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করতে হলে প্রয়োজন গবেষণায় বিনিয়োগ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য যে গবেষণার প্রয়োজন, তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং নীতিনির্ধারকদের গবেষণার বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে সক্রিয়ভাবে। তবে গবেষণা হতে হবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক, মানসম্পন্ন ও প্রায়োগিক, যা দেশের কাজে আসবে সার্থকভাবে। আশা করি, গবেষণায় বিনিয়োগ দেশকে উন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত করবে অদূর ভবিষ্যতে।
ড. সৈয়দ ইজাজ আহসান, সিনিয়র ফ্যাকাল্টি, ডারল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫