Ajker Patrika

রাজনীতি যখন লাভজনক পেশা

চিররঞ্জন সরকার
রাজনীতি যখন লাভজনক পেশা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীর হলফনামা জমা দেওয়ার নিয়ম কার্যকর হয় ২০০৮ সাল থেকে। যার মধ্যে প্রার্থীর আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব, তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। মন্ত্রী-এমপিরা হলফনামার মাধ্যমে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে অর্থ-সম্পদের হিসাব দিয়েছিলেন, আর এবারের দ্বাদশ নির্বাচনের হলফনামায় সম্পদের হিসাবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা গেছে। হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিদের পাঁচ-সাত থেকে কারও কারও শত গুণ পর্যন্ত সম্পদ বেড়েছে। শুধু মন্ত্রী-এমপিরাই নন, তাঁদের স্ত্রীরাও কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।

অনেকের শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বেড়েছে। তাঁদের স্ত্রীদের অনেকের কোনো আয়ের উৎস না থাকলেও, অর্থ-সম্পদের পরিমাণ স্বামীদের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি। যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়েছেন তাঁদের স্ত্রীরা।

বাড়ি, গাড়ি, স্বর্ণালংকার কিংবা নগদ টাকা, এমপি-মন্ত্রী ও তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের সবকিছুই বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। জমিজমা, কোম্পানির শেয়ার বা ব্যাংকের আমানত বেড়েছে অনেকের। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়ছে বার্ষিক আয়ের পরিধিও। লাখপতি থেকে কোটি কোটি টাকার সম্পদ হয়েছে।

তার মানে রাজনীতি করা, মন্ত্রী-এমপি হওয়া এখন খুবই লাভজনক একটা পেশায় পরিণত হয়েছে। এতে করে রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারণ মানুষ বিরূপ হয়ে উঠছে। অনেকেই কটাক্ষ করে বলছেন, রাজনীতি এখন কম পুঁজিতে বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে ‘ভালো’ উপায়।

ক্ষমতার রাজনীতি বড়লোক হওয়ার সেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপে পরিণত হয়েছে। এই প্রদীপ সবাই চায়। তাই তো ক্ষমতাসীনেরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। বিরোধীরা যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতা নিয়ে তাই এত মারামারি, খেয়োখেয়ি। কয়েক দশক ধরে এক নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে।

এটা অত্যন্ত সর্বনাশা প্রবণতা। এই প্রবণতা থেকে রাজনীতিকে বের করে আনা দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাজটা কে করবে? সমাজের বিবেকবান মানুষেরা, শিক্ষিত, সচেতন, জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিত মানুষেরা ক্রমে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তাঁরা একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগ করছেন। কোথাও কোনো জবাবদিহি থাকছে না। ক্ষমতা ভোগ ও প্রদর্শনের একটা সিস্টেম তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এই সিস্টেম ক্রমে শক্তিশালী ও অজেয় হয়ে উঠছে।

এই সিস্টেম কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, সেই আলোচনাটা সামনে আসা দরকার। দেশের স্বার্থে, রাজনীতির স্বার্থে সমাজের বিবেকবান মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষিত-জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতদের ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনীতিকে অবহেলা করলে সমাধান হবে না। রাজনীতি যাতে একটি সুনির্দিষ্ট পেশা হতে পারে এবং তাতেও উত্তরণের পথ রূপায়িত হতে পারে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

না হলে নেতারা ‘মানুষের সেবা করতে চাই’ বলে এই ডাল থেকে ওই ডালে দোল খাবেন। তিনি তাঁর পেশার কাজ যথাযথভাবে করবেন না। কেবল নিজে বড়লোক হওয়ার ফন্দি-ফিকির খুঁজবেন। অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখন যত তাড়াতাড়ি এটি বুঝব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।

বড়লোক হওয়া, ধন-সম্পদ বাড়ানো কোনো অপরাধ নয়। রাজনীতিবিদেরা যে বড়লোক হতে পারবেন না, তাঁদের ধন-সম্পদ বাড়বে না, এমন কোনো দিব্যি নেই। কিন্তু সেই সম্পদটা কীভাবে বাড়ছে, সেটা নিয়মনীতি মেনে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় হচ্ছে কি না, সেটা দেখা জরুরি।

তিনি ঠিকঠাকমতো ট্যাক্স দিচ্ছেন কি না, নিজের সম্পদ কম দেখিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নামে বেশি জমি-গয়না, টাকা দেখিয়ে একধরনের প্রতারণা করছেন কি না, সেগুলো দেখাও জরুরি। রাজনীতি কোনো অবস্থাতেই ঠগবাজি নয়; বরং একটি মহৎ সমাজকল্যাণের ব্রত। রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করা এবং দেশের সেবা করা।

একজন রাজনীতিবিদ রাজনীতিতে নাম লেখান দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করার জন্য। সমাজকে, সমাজের মানুষকে একটা সমৃদ্ধ জীবন প্রদানের অঙ্গীকার করেই রাজনীতিবিদেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। কিন্তু বাংলাদেশে যাঁরা রাজনীতি করছেন, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন, তাঁরা রাজনীতিকে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করছেন।

আর এ কারণেই তাঁদের সম্পদের হিসাবে দেখা যাচ্ছে বিশাল উল্লম্ফন। এটা কেবল কাগজ-কলমের হিসাবেই লক্ষ করা যাচ্ছে। দাখিল করা হলফনামায় যে সম্পত্তির হিসাব দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে তাঁদের সম্পদের পরিমাণ এর চেয়েও অনেক বেশি। সম্পদের এই বৃদ্ধির বিষয়টি কতটা নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এ ধরনের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি নানা প্রশ্ন সৃষ্টি করে।

সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি কখনো এক লাফে বাড়তে পারে না। কেউ যদি কোনো একটা ব্যবসা করেন, তাহলে ব্যবসায় তাঁর ধাপে ধাপে উন্নতি হয়। ব্যবসায় অনেক ঝুঁকিও থাকে। অনেক সময় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। কিন্তু রাজনীতিবিদদের সম্পদের হিসাব দেখে মনে হয়, তাঁদের ব্যবসায় কোনো ঝুঁকি ও লোকসান নেই। তাঁদের টাকা কেবল বাড়ে, বাড়তেই থাকে।

না হলে পাঁচ কিংবা দশ বছরে একজন মন্ত্রী-এমপির সম্পদের পরিমাণ ১০ থেকে ১০০ গুণ পর্যন্ত বাড়ে কীভাবে? এমপি হওয়া কি তবে আলাদিনের চেরাগ পাওয়া? মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের পরিমাণ দেখে রাজনীতি সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ দিনান্ত পরিশ্রম করে যেখানে টিকে থাকতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে রাজনীতির কান্ডারিরা অনায়াসে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন। সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদদের সম্পদের হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারছে না।

রাজনৈতিক দলের সংখ্যাবহুল আবহে আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দলগুলো যেমনই হোক, তাদের বাদ দিয়েও দেশের শাসনব্যবস্থা ও গণতন্ত্র হয় না। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বহাল রাখতে যে বন্দোবস্ত চালু আছে, তার নাম নির্বাচন। একে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ নামে আমরা ডেকেছি। নির্বাচনকে শিরোধার্য করে আমরা ভেবেছি, মতামত প্রদান হলো উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক অধিকারচর্চার ক্ষেত্র। কিন্তু তা আদৌ হচ্ছে কি? আমরা কি পারছি আমাদের উচিত-অনুচিত অনুভূতিকে, ভালো-মন্দ বোধকে এবং নীতি-দুর্নীতির মূল্যায়নকে আমাদেরই দেওয়া ভোটের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে?

একতরফা নির্বাচন, কিছু দলের ভোট বর্জনের বাইরে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এখন সামাজিক দায়বদ্ধতার ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা লাভের ধারণায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনীতি এখন পেশা, যা সমাজসেবা বা দেশসেবার ধারণার সঙ্গে সম্পর্কহীন। ব্যক্তিজীবনের থেকেও সমাজজীবনের মূল্য যাঁদের বেশি, তাঁরাই আগে রাজনীতিতে আসতেন। শেরেবাংলা ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বহু স্বাধীনতাসংগ্রামীর রাজনৈতিক দর্শন সেই ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই রাজনীতিবিদেরা ছিলেন জনগণের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। এখন রাজনীতিতে ‘দেশসেবা’ কথাটাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। যেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা নির্বাচিত হন, সেটাকে তাঁরা বেমালুম ভুলে যান। ব্যক্তিগত স্বার্থে দলত্যাগও এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

ব্যক্তিগত মর্যাদা বা সুবিধাই প্রাধান্য পাচ্ছে। নেতারা অনুগামী মানুষদেরও সেই লক্ষ্যে নিয়োজিত করেন, যেখানে সীমাবদ্ধ স্বার্থের গুরুত্ব দেশ বা সমাজের চেয়েও বড়। যেভাবে মন্ত্রী-এমপি ও তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন, সেটা গণতন্ত্রের জন্য ভয়ংকর। এর দ্বারা এক দিকে জনগণের সঙ্গে যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়, হত্যা করা হয় তাঁদের স্বপ্নকে, অপর দিকে গণতন্ত্রের প্রতি বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। গণতন্ত্র আর ব্যক্তিগত সুবিধাবাদের ধারণা সমার্থক হয়ে যায়।

তর্কের খাতিরে সেবা বা আদর্শ বাদ দিলেও, গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে একটি পেশা হিসেবে দেখা যাক। আমি একজন রাজনৈতিক চাকরিপ্রার্থী, জনগণের কাছে যাচ্ছি পাঁচ বছরের জন্য চাকরি বা পাঁচ বছরের ‘কনট্র্যাক্ট’ পেতে। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও চাকরিপ্রার্থী। যদি আমি নির্বাচিত হই, তাহলে পাঁচ বছরের জন্য চাকরি বা ‘কনট্র্যাক্ট’ পেলাম। এবার আমার কাজ হবে, আমার চাকরিদাতা, অর্থাৎ জনগণের চাহিদামতো কাজ করা, যাতে পাঁচ বছর পর আবার ‘কনট্র্যাক্ট’ পাওয়া যায়।

কিন্তু বর্তমানে যাঁরা রাজনীতিতে আসছেন, তাঁদের কতজন এভাবে ভাবছেন বা দেখছেন? রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখুন, আপত্তি নেই—কিন্তু ঠিকভাবে দেখুন। শুধু নিজের ক্ষুদ্র-স্বার্থের কথা না ভেবে জনগণের স্বার্থের কথা ভাবলে দেশের ভালো, আপনারও লাভ। জনগণের স্বার্থে কাজ করাটাই আপনার কাজ, তাদের বোকা বানানো নয়। এভাবে ভাবলেও হয়তো আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ার দিকে এগোতে পারব।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পদোন্নতি দিয়ে ৬৫ হাজার সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা: ডিজি

দিনাজপুরে হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে হত্যা: ভারত সরকার ও বিরোধী দল কংগ্রেসের উদ্বেগ

সমালোচনার মুখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের নিয়োগ বাতিল

আজ থেকে ৫০০ টাকায় মিলবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট

মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত