Ajker Patrika

স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ

Thumbnail image

স্বপ্ন তৈরি হয় স্বপ্ন ঝরে যায়; বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ পায় না। দিনমজুর দিনমজুরই থাকে, গার্মেন্টসশ্রমিক গার্মেন্টসেই কর্মী হিসেবে থেকে যায়। বৈশ্বিক মুনাফা বৃদ্ধি পায়, কোটিপতিরা কোটিপতি হতেই থাকে, গরিবেরা গরিবের হিসাব থেকে বের হতে পারে না। অথচ কাজ বেড়ে গেছে অনেক গুণ, কাজের দামও এখন অনেক বেশি; কিন্তু দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া প্রতিযোগিতায় হেরে যেতে হচ্ছে আমাদের নিম্নবিত্তদের। এই শ্রেণিটা কখনো আলোর কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে না। আশান্বিত হয়, আশাজাগানিয়া স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আশা-আলো একসঙ্গেই নিভে যায়। রাজনৈতিক উত্থান আর পতনের ডামাডোলে হারিয়ে যায় তাদের সব স্বপ্ন। এরই মাঝে বস্তির ঘরে প্রেম হয়, ভালোবাসার ভিত তৈরি হয় এবং নহবতের সানাই বেজে ওঠে। শুরু হয় আরেক প্রজন্মের নতুন পৃথিবী আর নতুন পৃথিবীর পুরোনো গল্প। লেখাপড়াহীন জীবনে বেড়ে ওঠা শিশুরা শ্রমিক হওয়া ছাড়া অন্য কোনো স্বপ্ন দেখতে পায় না। তাই তারা স্বাভাবিকভাবে অপরাধীচক্রে মিশে যায়, নেশাগ্রস্ত হয়, জীবনের অর্থ তাদের কাছে বরাবরই অর্থহীনই থেকে যায়।

গ্রামীণ জীবনে জনমজুর হয়ে জীবনযাপনের প্রক্রিয়া হাজার বছরের ঐতিহ্য। যান্ত্রিক সভ্যতার কারণে কাজের ধরন পাল্টেছে; কিন্তু মানুষের স্বপ্নগুলো ওপরে উঠতে পারেনি। আজও মোটা ভাত, মোটা বস্ত্র পেতে অনেক লড়াই করতে হয় তাদের। সাংসারিক জীবনে সুখ-শান্তির ছোঁয়া হাতের বাইরে সব সময়। নানা কারণে ঋণে জর্জরিত হয়ে প্রতিদিন কিস্তির টাকা দিতে হিমশিম খেতে হয়; ফলে নানাভাবে সংসারে বিবাদ-ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। কোনোভাবে দিন যায়, দিন কাটে; স্বপ্নেরা স্বপ্ন দেখিয়ে হারিয়ে যায়। সন্তানকে মানুষ করার প্রত্যাশা থাকে, একদিন বড় চাকুরে হয়ে সন্তান তাদের সব দুঃখ ঘুচিয়ে দেবে বা সন্তানেরা নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে—এরূপ ভাবনার মৃত্যু বরাবরই হয়ে থাকে। ভাবনাটুকুতেই আনন্দ, সুখ! সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক কিছুই করা সম্ভব; সরকার এসব ক্ষেত্রে বহু রকমের প্রকল্প হাতে নেয় এবং কোটি কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে; কিন্তু সেসব প্রকল্পের অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয় না আর হলেও তা হয় ‘ধরো হে লক্ষণ’ গোছের।

মাঝে মাঝে দু-একজন নানাভাবে ছিটকে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পায়, আলোকিত হতে পারে; তবে সেটা নিজের কাছে শুধু; আলোকবর্তিকা ছড়ানোর শিক্ষা তারা পায় না। লেখাপড়ার সীমাবদ্ধতা এবং জ্ঞানের পরিধি এতটাই সীমিত যে অন্যদের মানুষ ভাবতে হয় এমন শিক্ষা সে পায়নি; বরং কীভাবে মন্ত্রী-এমপি হয়ে আরও আরও বড়লোক হওয়া যায়, সেই পথে হাঁটে; আর হয়তো অনেকেই সেটা পেয়েও যায়। এই শ্রেণিটা তাদের ফেলে আসা অতীতটাকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলে; ফেলানীর মাসি, ফজলু চাচার চায়ের দোকান, বছির ভাইয়ের সবজির দোকানের অপরিশোধিত বাকি, গরিব মা-বাবা, ভাইবোন কাউকেই আর সে মনে রাখতে চায় না। কারণ সে এমপি হবে, মন্ত্রী হবে, কোটি টাকা দামের গাড়িতে ঘুরে বেড়াবে—এসব স্বপ্ন এখন তার হাতের মুঠোয়। আর হয়েও যায় এরাই সব। এরাই হয় কর্ণধার, আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা। পৃথিবীটা কতই কঠিন, আবার কতই সহজ।

জীবনের মানে বোঝার আগেই যদি কেউ মন্ত্রীটন্ত্রী হয়েই যায়, তাহলে এত ঢাকঢোলের কী আছে! এখানে সবকিছুই সম্ভব। হীরক রাজার দেশের একনায়ক রাজার চেয়েও সহজতর জীবন এখানে। এখানে রাতারাতি অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। স্বপ্ন ছাড়াও স্বপ্নপূরণ হওয়ার সুযোগ এখানে আছে। পৃথিবীতে নিত্যনতুন ধারণার সূতিকাগার এখন বাংলাদেশ। এখানে দম্ভের সঙ্গে পৃথিবীর যেকোনো শক্তিধর দেশের সঙ্গে মোকাবিলা করার গালগল্প করা যায়—সে শক্তি থাকুক আর না থাকুক। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা সেজে ভারতজুজুর ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানি সিস্টেমের কথা বলে রাজপথ ভরতে এখানে সময় লাগে না; কারণ এরা অধিকাংশই অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা মূর্খ। এদের কেজি দরে কেনা যায়, বিক্রিও করা যায়। টাকা দিতে পারলে সবকিছুই সম্ভব। অভাব-অনটন আর নেশার ছোবল এখানকার মানুষকে আর মানুষ রাখেনি। এদের ডানে ঘোরানো যায়, আবার পরক্ষণেই বামেও ঘোরানো যায়।

অস্থির মানসিকতার জীবনযাত্রায় টাকার সরবরাহ করাতে পারলে পুরো সমাজকে পাল্টিয়ে দেওয়া যায়। শিক্ষা, রাজনীতি এখানে তেমন কিছুই নয়; যা ঘটে আর যা ঘটানো যায়, সেটাই শিক্ষা, সেটাই রাজনীতি। স্বকীয়তা বলতে কিছুই নেই; নির্ভরশীলতা এখানে বড় একটি নিয়ামক, যা দিয়ে ভালোকে মন্দ আর মন্দকে ভালো হিসেবে দাঁড় করানো খুবই সহজ কাজ। টানাপোড়েনের জীবনে হিতাহিতজ্ঞান বলতে কিছুই থাকে না। স্বপ্নের লেশমাত্র আর দরকার পড়ে না।

স্বপ্ন কী? অযথা একটি মানসিক কষ্টের নাম, যা ইহজন্মে পূরণ হওয়ার নয়।

লেখক: কবি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত