Ajker Patrika

রঙ্গিলা নাও, কোথায় চইলা যাও

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২২, ২২: ৫১
রঙ্গিলা নাও, কোথায় চইলা যাও

এত স্পষ্টভাবে এখান থেকে জোহরের আজান আগে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। বহুবার এসেছি—সেটা পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার বহু আগে যেমন, কাজ শুরু হওয়ার সময়ও তেমনি। আবার পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর একেবারে গত পরশু। সেই কোলাহল এখন আর নেই। মাওয়া ঘাট এখন সুনসান। অথচ এই কয়েক দিন আগেও মাওয়া ঘাট ছিল দক্ষিণবঙ্গ যাওয়ার গেটওয়ে। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কিছুটা সামনে ডান দিকের সরু রাস্তাটায় ঢুকলে সোজা মাওয়া ঘাট—পুরোনো মানুষদের সবাই এই রুট চেনে। এই রাস্তা চন্দ্রেরবাড়ি বাজার পেরিয়ে একেবারে মাথায় যে প্রায় গোল জায়গাটায় গিয়ে মিশেছে, সেটাই মাওয়া ঘাট। এর পোশাকি নাম শিমুলিয়া নৌবন্দর। পদ্মার তীর।

সারা দিন শত শত বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনের শব্দ, হাজার হাজার মানুষ—বিচিত্র কিসিমের, ফেরির ভোঁ, দালালের দৌরাত্ম্য, লঞ্চের হুইসেল, স্পিডবোটের লম্ফঝম্প, হাত বাড়িয়ে থাকা ভিখিরি—বৃদ্ধ-তরুণ-নারী-পুরুষ-শিশু! নাম না জানা কুলফি আর বাদামওয়ালা, গায়ে পড়ে উপকার করতে আসা পকেটমার, সন্ধ্যার মুখে ইশারা দেওয়া যৌনকর্মী, ত্রস্ত গেরস্ত, সাবধানি গেরস্ত বউ। শতসহস্র মানুষ দেখে বিহ্বল হয়ে যাওয়া নতুন জামা গায়ে দেওয়া শিশু। ফেরিতে যাওয়ার করিডরে ধাক্কাধাক্কি, লঞ্চের টিকিটের কিউতে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো কত রকম মানুষ, কত কত শব্দ ২৪ ঘণ্টা!

চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে, এখান থেকে জাজিরা পয়েন্ট পর্যন্ত দিনরাত চলাচল করছে আঠারোখানা ফেরি। দিনে অন্তত পাঁচটি ট্রিপ। শত শত যানবাহনে হাজার হাজার মানুষ পারাপার হচ্ছে। বিকট কোলাহল। এর সঙ্গে মিশে থাকে ইলিশের তেলে পোড়া সুগন্ধ, বিড়ি-সিগারেটের তামাক পোড়া আর ঘামের গন্ধ। একদিকে বাস, অন্যদিকে ট্রাকস্ট্যান্ড। স্পষ্টভাবে জোহরের আজান শোনার উপায়ই ছিল না। আর এখন সব পড়ে আছে। সুনসান।

শিমুলিয়া নৌবন্দরের সাইনবোর্ডের বাঁ দিকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু বাস। তার মধ্যে ব্যানারে শিক্ষাসফর লেখা পিকনিক পার্টিও আছে। সব বাস বন্ধ। দুপুর বলে হয়তো সবাই খেতে গেছে। গুটগুট করে শ্যালোমেশিন দিয়ে বাঙালি মস্তিষ্কে তৈরি ক্রাশার চলছে। তাতে চাপা পড়ছে আখ। কাচের গ্লাস ভরে উঠছে তার রসে।

প্রখর রোদে ক্রাশারের পাশে ছাতার নিচে বসে আছেন হুমেদ আলী। চোখে চোখ পড়লেই মানুষের কাছে জানতে চাইছেন, ‘আখের রস খাবেন নাকি?’ কেউ তেমন সাড়া দিচ্ছেন না। পঞ্চাশোর্ধ্ব হুমেদ আলী বারবার দমে যাচ্ছেন। পাশ কাটাতে গিয়ে তাই চোখ নামিয়ে এড়িয়ে গেলাম। সামনে বর্ষার প্রমত্তা পদ্মায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোল খাচ্ছে ‘ফেরি ক্যামেলিয়া’। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ফেরি কুঞ্জলতা। লোকজন তার পাটাতনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। ফেরির লোকজন কেউ স্নান করছেন গামছা পরে। সারেং নেই, কোনো ভোঁ নেই। যানবাহনের চালকদের তাড়াহুড়ো নেই।

প্রায় গাছহীন মাওয়া ঘাট পুড়ছে শ্রাবণের রোদে—সবকিছুকে বেশ খানিকটা সোনালি দেখায় সে জন্য। ফটোগ্রাফির ভাষায় এটা হয়তো ওয়ার্ম লাইট। ত্রিশ দিনের কম সময়ে একটি মুখরিত জনপদের নিস্তব্ধ হওয়া দেখলে কিছুটা ধন্দই লাগে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত