Ajker Patrika

আরও একটি শোকার্ত দিন

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আরও একটি শোকার্ত দিন

একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্ররা মারা গেছেন, এ সংবাদ রাষ্ট্রব্যাপী ছড়িয়ে গেলে পুরো পূর্ব বাংলা যেন পরিণত হয় এক নতুন দেশে। শাসকের দল ভেবেছিল, গুলি করে স্তব্ধ করে দেবে আন্দোলন, কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং সব হলে ছাত্ররা কালো পতাকা উত্তোলন করেন, সবাই ধারণ করেন কালো ব্যাজ। পুলিশের পক্ষে সে সময়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো শক্তি ছিল না। তাই পুলিশের সঙ্গে ইপিআর আর সেনাবাহিনীও এসে রাজপথ টহল দিতে থাকে।

মেডিকেল হোস্টেলের সামনে শহীদদের গায়েবানা জানাজা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারিতে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের লাশ পুলিশ কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল বলে গায়েবানা জানাজা পড়া হয়। অসংখ্য মানুষ সেই জানাজায় অংশ নেন। তবে কত মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। ৫ হাজার থেকে ৩ লাখ পর্যন্ত মানুষের সমাগম হয়েছিল বলে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে অনেকে মনে করেন, উপস্থিতি ছিল ২৫-৩০ হাজার।

গায়েবানা জানাজা শেষে একটি বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, ছাত্র হত্যার খবর পাওয়ার পর ছাত্রদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ, সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ রাস্তায় বেরিয়ে আসে।

২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। বিশেষ করে নবাবপুর রোডে ছাত্র-জনতার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তৎকালীন ভিক্টোরিয়া পার্ক পেরিয়ে মিছিল এগিয়ে যায় রথখোলার দিকে। সেখানে এসে থেমেছিল একটি সৈন্যবাহী ট্রাক। মানসী সিনেমার গলি থেকে পুলিশ ও সৈন্যদের একটি অংশ গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। একটি ট্রাক থেকে গুলি ছোড়া হয়। সিরাজুদ্দিন নামে একটি ছেলের কোমরের ওপর গুলি লাগে। তিনি ছিলেন তাঁতী বাজারের বাসিন্দা।

এ দিন উন্মত্ত ছাত্র-জনতা মর্নিং নিউজের ছাপাখানা জুবিলি প্রেসে হামলা চালায়। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় সরকারের পক্ষে একপেশে সংবাদ পরিবেশন করায় ছাত্র-জনতা প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রেসের ওপর।

২২ ফেব্রুয়ারি কতজন শহীদ হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে ঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ভাষাসংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিকের ভাষ্যমতে, অন্তত চারজন এ দিন শহীদ হয়েছিলেন। রাস্তায় যে পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছিল, তারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় গুলিবর্ষণ করেছিল। গুলি করার পর লাশ গুম করে দেওয়া হয়েছিল বলে এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন।

২৩ ফেব্রুয়ারির আজাদ পত্রিকায় লেখা হয়, এ দিন অন্ততপক্ষে ৪ জন প্রাণ দিয়েছেন এবং শতাধিক আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একই দিন সাপ্তাহিক সৈনিক লিখেছিল (বিশেষ শহীদ সংখ্যা) ৮ জন নিহত হয়েছেন এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের বর্ণনায়, নবাবপুরে ৪ জন, কার্জন হলে ২ জন এবং রেলওয়ে কলোনির সামনে ১ জন নিহত হয়েছেন। তবে, কার্জন হলের সামনে নিহত হওয়ার সংবাদটি অতিরঞ্জিত বলে অনেকেই মনে করেন।

এ দিন যাঁরা নিহত হন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন শফিউর রহমান, আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিন।

২২ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা কিংবা সান্ধ্য আইনের ভয়াবহতা উপেক্ষা করে ছাত্ররা মুক্তভাবেই তাঁদের উপস্থিতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সে সময় ছাত্রদের এলাকায় এসে নিজেদের কঠোরতার পরিচয় দেওয়ার মতো সাহস সরকারি বাহিনীর ছিল না। বলে রাখা ভালো, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অঙ্গীকার যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা তো বটেই, যাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই নেতারাও তখন মেডিকেল ব্যারাকে এসেছেন।

২২ ফেব্রুয়ারি আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক এবং সিলেট জেলা মুসলিম লীগের সদস্য মাহমুদ আলী মুসলিম লীগ কাউন্সিল থেকে এবং লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।

এই দিন পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপনা পরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারিও উত্তাল ছিল রাজপথ। কিন্তু এখন আন্দোলন কোন পথে এগোবে, তা নিয়ে ছাত্র নেতৃত্ব অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে, কিন্তু সাংগঠনিক ক্ষমতা কমে যাচ্ছে—এই ছিল তখনকার অবস্থা।

কিন্তু এ কথাও ঠিক, সেদিন মেডিকেল শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পথ ধরে আন্দোলন আবার বেগবান হচ্ছিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত