Ajker Patrika

নিরাপদ দেশ

মামুনুর রশীদ
নিরাপদ দেশ

বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগটি ছিল পঞ্চাশ দশকের কলাভবন। এই কলাভবন থেকে যে পথটি বর্তমানে শহীদ মিনারের দিকে এসেছে, সেই পথের দুই ধারে একদা ছিল অনেক কৃষ্ণচূড়ার গাছ। গাছে ফুটত লাল রঙের কৃষ্ণচূড়ার ফুল। ষাটের দশকে যখন তীব্র ছাত্র আন্দোলন চলছিল, তখন ফুলের রংটি বদলায়নি কিন্তু আমাদের কাছে কেন যেন মনে হতো এই কৃষ্ণচূড়ার লাল রংটির অনেক মানে আছে। ভাষাশহীদদের রক্ত যেন জমাট বেঁধে আছে এই কৃষ্ণচূড়ার ফুলে ফুলে।

রঙের এই যে ব্যাখ্যা, সেটি আজ আর ছাত্রদের মধ্যে নেই। অবিরাম রক্ত ঝরছে। শত্রুর গুলিতে নয়, সহোদরের নির্যাতনে। আবরার হত্যা এবং সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সতীর্থদের আক্রমণে রক্তাক্ত হলো আবার ক্যাম্পাস। এ রকম ঘটনা প্রায়ই আমরা সর্বত্রই দেখতে পাই, যেটি ছিল দুঃস্বপ্নের অতীত। সে ঘটনাটি প্রতিনিয়ত আমাদের হৃদয়কে শুধু যে বিদ্ধ করছে তা নয়, একটা অজানা আশঙ্কায় বারবার কেঁপে উঠছি যে আমাদের সন্তানেরা আর কত নিরাপত্তাহীনতার দিকে যাবে?
শহর ও গ্রামে আজকাল দেখতে পাই মায়েরা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে স্কুলে যান আর একেবারেই বয়স কম হলে মা বাইরে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন তাঁর সন্তানের ছুটি হবে এবং তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। প্রশ্ন হচ্ছে শিশুদের স্কুলেও কি এ ধরনের ভ্রাতৃঘাতী ঘটনা ঘটছে? হয়তো ঘটছে না, কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতীকী। প্রতীকী এই অর্থে যে তাঁর সন্তানের নিরাপত্তা কেউ দিচ্ছে না। একমাত্র মা যে তাঁর সন্তানকে ১০ মাস গর্ভে ধারণ করেন তা যথেষ্ট নয়, তাঁকেই পরবর্তীকালে এই সন্তানের একক নিরাপত্তার দায় নিতে হবে। অথচ আজ থেকে ৩০ বছর আগেও এই ভীতিটি ছিল না। হ্যাঁ, তখন একটা ব্যাপার ছিল যে বাচ্চাটি একা স্কুলে যেতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে, পথ হারিয়ে যেতে পারে; এসব কারণে একটা বয়স পর্যন্ত সঙ্গে যেতে হতো। কিন্তু এখন সার্বক্ষণিক প্রহরার প্রয়োজন হয়।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ছাত্রদের নিরাপত্তার কাজে অতন্দ্র প্রহরী হচ্ছেন শিক্ষকেরা। শিক্ষকেরা এখন সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন ছাত্রসংগঠনগুলোর ওপর।

ছাত্রসংগঠনের নেতারা অত্যন্ত হাসিমুখে এই দায়িত্ব নিয়ে যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হয়েছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কেন্দ্রগুলোতে টর্চার সেল তৈরি করে তারা এক অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছে। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের ছাত্রনেতারা দিনের পর দিন ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, পাঠচক্র ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করত। কিন্তু আজ তার বালাই নেই, রাষ্ট্রক্ষমতাই তাদের সব ধরনের নির্যাতনের লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। শিক্ষকেরা একটা দুর্বল রেফারির জায়গায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মাঠ ছেড়ে চলে যান অথবা এ দায়িত্ব পালন করতেও আসেন না।

অথচ আমাদের সামনেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার পাশেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সন্তানদের ঠিকানা ছিল আবাসিক হোস্টেল এবং হলগুলো। সেখানে কোনো ক্ষমতার দাপট ছিল না, পেশিশক্তির ব্যবহার ছিল না এবং টাকার গরমও ছিল না। খুবই অল্প টাকার মানি অর্ডার আসত, তা দিয়েই কায়ক্লেশে মাসের পর মাস জীবনধারণ চলত। সবার মধ্যেই ছোট্ট একটা স্বপ্ন। পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকরি পেতে হবে এবং চাকরির টাকায় বাবার দারিদ্র্যের সংসারটাকে চালাতে হবে। তাই লেখাপড়াটাকে ঠিক রেখেই অন্য সব চিন্তাভাবনা। কিন্তু ১৯৪৮ সাল থেকে এই অন্য সব চিন্তাভাবনাই মুখ্য হয়ে ওঠে। যে পাকিস্তান রাষ্ট্র অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল, সেই রাষ্ট্রই একদিন সকালে পূর্ব বাংলার মানুষের ভয়ংকর এক শত্রুতে পরিণত হয়। অর্থনৈতিক দুর্দশা তো আছেই, যার কোনো সুরাহা সেই সরকার করতে পারেনি, কিন্তু শাসন-শোষণের নীলনকশা সে করে ফেলেছে। প্রথমেই সেই নীলনকশার মধ্যে আছে একটি জাতি ধ্বংসের পরিকল্পনা। ভাষা, মায়ের ভাষাকে স্তব্ধ করে সেই জায়গায় একটি বিদেশি ভাষাকে নিয়ে আসা। ভাষা সম্পর্কে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সাম্প্রদায়িক শক্তির নেতাদের হয়তো কোনো ধারণাই ছিল না। ভাষা যে মানুষের জীবনের সঙ্গে হাজার হাজার বছর ধরে জড়িত, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকায় একজন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করে বসলেন উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, একেবারে সংখ্যালঘিষ্ঠদের যে ভাষাটি আছে, তা-ও তার কাছে অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীতে এমনও ভাষা আছে যে ভাষায় মাত্র কয়েক শ মানুষ কথা বলে। কিন্তু সেই কয়েক শ মানুষও তার মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়। হয়তো নানা কারণে ভাষাটি অবলুপ্ত হওয়ার পথে; তবু সেই ভাষার শেষ মানুষটি পর্যন্ত ভাষাটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে থাকে।

আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন সাল পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক চর্চাও তেমন একটা রূপ লাভ করেনি। কিন্তু কেমন করে ছাত্রসংগঠনগুলো যেন আস্তে আস্তে একটা আকার পেতে শুরু করেছে। যার একটা বড় বিস্ফোরণ ঘটে গেল বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে। অনুন্নত সেই পূর্ব বাংলায় ছা-পোষা পরিবারের সন্তানেরা গর্জে উঠল একটা বিষয়ে আর তা হলো, ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। এই ভাষাকে রক্ষা করতে গিয়ে তারা দেখতে পেল দুঃশাসনের এক ভয়াবহ চিত্র। তখনকার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা মাসের পর মাস বেতন পান না, শিক্ষাব্যবস্থাকে উপযোগী করার কোনো প্রচেষ্টাও সরকারের নেই, ছাত্রদের মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে স্কুলে পড়তে হয়। শিক্ষকদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করারও কোনো উপায় নেই। পাকিস্তানি প্রশাসনিক যন্ত্র তখন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেনি। কিন্তু অস্ত্রের পথকে তারা ঠিকই বেছে নিয়েছিল, যার পরিণতিতে ডেকে এনেছিল সামরিক শক্তিকে। এই সামরিক শক্তি যত নির্যাতন বাড়াতে লাগল, ততই সংগঠিত হতে লাগল এ দেশের রাজনীতি এবং ছাত্রদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন। 
ছাত্রদের দল যে একটাই তা নয়, বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছাত্ররাও ঐক্যবদ্ধ হতে লাগল। সেখানে কোনো গায়ের জোর চলেনি, নিজেদের মধ্যে কোনো সংঘাত গড়ে ওঠেনি। হ্যাঁ, দল একটা ছিল তা হলো আদর্শিক। কিন্তু খুব সহজেই ঘোষিত শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। তখনকার সামরিক শক্তি একটি পেশিশক্তির ছাত্রসংগঠন গঠন করতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির সামনে তারা দু-চারটে মারামারি ছাড়া তেমন কিছু করতে পারেনি। ছাত্ররা তখন সামাজিক সম্মানের শীর্ষে। আমার মনে পড়ে, খেয়ার মাঝিরাও ছাত্র পরিচয় পেলে এক আনা পয়সাও নিতে চাইতেন না। নানা ধরনের সম্মান মিলত ছাত্রদের। একুশের পথ ধরেই ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিক তাদের ঐক্য বাড়াতে বাড়াতে একসময় তা দাবানলে পরিণত করল, যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ হলো এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়া গেল।

সেই স্বাধীন রাষ্ট্রের আজ একান্ন বছর, নতুন পতাকা এসেছে, জাতীয় সংগীত এসেছে, এসেছে ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর, একুশে ফেব্রুয়ারি ও পয়লা বৈশাখ। এই সময়গুলোতে আড়ম্বরের শেষ নেই। পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকেই শুরু হয়েছে প্রায় সর্বত্রই বইমেলা। হাজার হাজার নতুন বইয়ের গন্ধে মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ। প্রায় প্রতিদিনই বাংলা ভাষার শক্তি, তাৎপর্য, ইতিহাস এবং নানান বিষয় নিয়ে সভা, সেমিনার, আলোচনা ও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। যেহেতু ফাল্গুন এসে গেছে, তাই রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছে বাঙালি; যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্যালেনটাইনস ডে। মানুষ নিয়তই নিঃসঙ্গ, বিশেষ দিনগুলো তাকে সংগীতে পরিপূর্ণ করে ফেলে। একে অপরের সঙ্গে একটা যোগসূত্রে আবদ্ধ হয়। কিন্তু এই আবদ্ধ হওয়াটাও ক্ষণিকের। ফেব্রুয়ারি মাসটি শেষ হবে, আরেক ফেব্রুয়ারি না আসা পর্যন্ত সে নিঃসঙ্গই হয়ে থাকবে। ভাষা নিয়ে ভালোবাসা, ভাবনা ও ভাষাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা এসবই হয়ে থাকবে ম্লান, নিঃসঙ্গ, একা।

নিয়মিত কোনো চর্চা আমাদের চরিত্রে যেন নেই আর সেই জায়গা দখল করবে অর্থ লোলুপ মানুষের দুর্নীতি, অবৈধ দখলের পাঁয়তারা এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের এক নিষ্ঠুর চিত্র। আমরা অতীতের গৌরব থেকে নতুন গৌরবের জন্ম দিতে অক্ষম হয়ে পড়ি। তাই উৎসবের সময়ও দেখা যাবে অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটছে একই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে। যে ভাষা-সংস্কৃতির চর্চা তা-ও ক্ষুণ্ন হয়ে যাবে, সতীর্থের রক্তে রঞ্জিত হবে হাত, যে হাতে একদা ভাষাকে রক্ষা করার সুদৃঢ় মুষ্টি তৈরি হয়েছিল। ভাষাকে রক্ষা করার আরেকটি রক্তাক্ত সংগ্রাম কি প্রয়োজন আছে, যা আমাদের শিক্ষা দেবে একটা নিরাপদ দেশ গড়ার?

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত