Ajker Patrika

বাঙালি মুসলমানের খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতি

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৭: ৪৫
Thumbnail image

মানুষের জীবনযাপনে এবং বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য বড় প্রয়োজন। যেকোনো প্রাণীর অস্তিত্বের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ খাদ্যের ইতিহাস। শিকার থেকে একদা ফসলের সন্ধান পেয়েছিল মানবজাতি। সেই থেকে একটা বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছিল খাদ্য সংস্কৃতিতে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আগুন। আগুন এবং কাঁচা ফসলের সম্মিলনে নতুনতর খাদ্যের সন্ধান পেতে শুরু করল মানুষ।

মানুষ ছাড়া প্রাণিজগৎ শুধুই খাদ্যের সন্ধান করে। অন্য প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। মানুষ তার বাঁচার প্রয়োজনে খাবারের সন্ধান করে কিন্তু তার আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। আচ্ছাদনের জন্য লতাপাতা থেকে শুরু করে একসময় কাপড় আবিষ্কার করে ফেলে। ভাবের আদান-প্রদানের জন্য ভাষার আবিষ্কার হয়। নিজের আনন্দ, বেদনা, উল্লাস প্রকাশের জন্য আসে নৃত্য, গীত, সাহিত্য, চিত্রকলা। এর সঙ্গে মস্তিষ্কও উন্নত হতে থাকে। মানুষ পরিচিত হয় উন্নত এবং শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কের জন্য।

কালে কালে গড়ে ওঠে সভ্যতা এবং সংস্কৃতি। জানা ইতিহাসে আমাদের এই অঞ্চল আড়াই হাজার বছর ধরে এক উন্নত সংস্কৃতির ভূখণ্ড বলে পরিচিত ছিল। শিল্প-সাহিত্য, খাদ্যাভ্যাস, পোশাকপরিচ্ছদ—সবকিছুতেই সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়। বৌদ্ধদের শাসনামলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিদর্শন পাওয়া গেছে। রাজ্য শাসনের জন্য নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক যেমন ছিল, তেমনি উদার, নৈতিকতাসম্পন্ন মহৎ শাসকদেরও ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই এ দেশে বিদেশি শাসনের সূচনা হয়। সেই থেকে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিরও সূচনা হয়—প্রথমে তুর্কি, তারপর পাঠান এবং তারপর মোগল এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ। ধর্মের বিভাজনের ভিত্তিতে পোশাক, খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে। নতুন ভাষার আমদানি হয় এবং উপনিবেশের নতুন নতুন উপাদান জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কখনো কখনো নানাভাবে প্রভাবিত করতে থাকে।

এই অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসে তেমন পরিবর্তন না হলেও একটা শ্রেণির মধ্যে ব্যাপকভাবে খাদ্যের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই শ্রেণি হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর একটি অংশ। শাসকগোষ্ঠীর কেন্দ্র থেকে তা একেবারে নিচু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। মুসলিম শাসনামলে এ অঞ্চলে বিভিন্ন দেশর নানা খাবারের সূচনা। এই খাবার সম্পূর্ণভাবে পারস্যের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে বৌদ্ধ এবং হিন্দু শাসকেরা আমিষের পরিবর্তে নিরামিষ ভোজনের সংস্কৃতি গ্রহণ করে। পোলাও, বিরিয়ানি, কাবাব এবং গো-মাংস ভক্ষণের দিকে মুসলমানদের আগ্রহ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। উপমহাদেশের বড় বড় শহরে এই খাবারগুলোর ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। দেশভাগের পর পাকিস্তান নামে দুটো ভূখণ্ডে এই খাবারের প্রভাব লক্ষণীয়; বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তান দরিদ্র, তাই এই সব খাবার সমাজের উঁচু শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হাতে গোনা কয়েকটি রেস্তোরাঁয় এই সব খাবার পাওয়া যেত।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন মধ্যবিত্তের কাছে অর্থ আসতে শুরু করে, তখন থেকেই এই সব খাবার জনপ্রিয় হতে থাকে। এখন শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহরে লাল কাপড়ে মোড়ানো বড় বড় হাঁড়িতে তেহারি, বিরিয়ানি এসব প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমাদের খিচুড়ি। খিচুড়ির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাসি এবং গরুর মাংসের একধরনের মিশ্রণ। কিন্তু কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীর মধ্যে জনপ্রিয় পাশ্চাত্যের খাবার পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ ইত্যাদি। এসবকে ওদের দেশেই বলে জাংক ফুড এবং বিশ্বাস করে এসব যথার্থই অস্বাস্থ্যকর খাবার। ঢাকা শহরজুড়ে এখন বিরিয়ানি, তেহারি এবং কাচ্চির মহোৎসব চলছে। যেকোনো উৎসবে, সম্মিলনে এসব খাবারের সমারোহ। ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, উত্তরা, পুরান ঢাকার সর্বত্রই এখন কাচ্চি বিরিয়ানির প্রবল প্রভাব। কোনো কোনো পরিবার তিন বেলাই এসব খাবার খেয়ে থাকে।

ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোড থেকে ২ নম্বর পর্যন্ত বড় রেস্তোরাঁর সংখ্যা ১ হাজার ৩৫০টি। আর জিগাতলার রাস্তা বা শংকর কিংবা লালমাটিয়া এসবের পথ এবং গলিপথে অসংখ্য খাবারের দোকান। যার মধ্যে অবশ্যই বিরিয়ানি আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমাদের প্রধান খাদ্যই বিরিয়ানি। আনন্দে, উৎসবে, বিবাহে একমাত্র খাবার বর্তমানে কাচ্চি বিরিয়ানি এবং পশ্চিমা দেশের রোস্ট। সেই সঙ্গে মোগলাই কাবাব ও ফিরনি। চায়নিজ রেস্তোরাঁয়ও বিবাহ উৎসবে বিরিয়ানি এবং পোলাও খাওয়ানো হয়। যেসব জায়গার কথা উল্লেখ করেছি, এসব জায়গায় কোনো পাঠাগার নেই, সুন্দর কোনো পার্ক নেই এবং চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ঢাকা শহরে কোটি কোটি মানুষের বসবাস। অন্য বড় শহরগুলোতেও তাই। কিন্তু এই শহরগুলোতে খাদ্য ছাড়া কোনো বিনোদন নেই। পরিবারগুলোতেও সংস্কৃতিচর্চা উঠে গেছে এবং পাঠবিমুখ একটি জাতিতে বাঙালি মুসলমান দাঁড়িয়ে গেছে।

এই রেস্তোরাঁগুলোয় মাঝে মাঝে স্থান সংকুলান হয় না। বেইলি রোডে একদা দুটি থিয়েটার হল, একাধিক বইয়ের দোকান এবং কিছু শাড়ির দোকান ছিল। খুব একটা ভিড়ের জায়গা ছিল না। কারণ আশপাশেই সরকারি ও বেসরকারি আবাসিক এলাকা এবং অদূরেই শান্তিনগর বাজার। সেখানে সকালের নাশতার জন্য ছিল জলখাবার নামে একটি মিষ্টির দোকান। উৎকৃষ্ট লুচি ও সবজি পাওয়া যেত। সেই সঙ্গে সুজির হালুয়া ও মিষ্টি। মাত্র তিরিশ বছরে এলাকাটি কাপড় এবং খাবারের দোকানের একটা স্তূপে পরিণত হয়েছে। অনিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে নানা দালানকোঠা। পাশেই ভিকারুননিসা স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী স্কুল ও কলেজ। ফলে সারা দিন এখানে প্রবল যানজট, গাড়ির হর্ন, ধোঁয়া—সব মিলিয়ে একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।

সম্প্রতি প্রায় অর্ধশত জীবন দগ্ধ হওয়ার পর জানা গেল, এসবই নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতির ফলাফল। গ্যাস সিলিন্ডার, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনার ওপর কোনো তদারকিই ছিল না। ক্ষীণ কণ্ঠে সিটি করপোরেশনের কর্তারা বলেছেন, তাঁরা নাকি নোটিশ দিয়েছেন, কিন্তু রেস্তোরাঁর মালিকেরা কর্ণপাত করেননি। কর্ণপাত না করলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা-ও তাঁরা স্পষ্ট করে বলেননি। যাঁরা এই সব রেস্তোরাঁয় যান তাঁরাও এই অনিয়ন্ত্রণ লক্ষ করেন না। তাঁরাও তাঁদের নাগরিক দায়টুকু পালন করার প্রয়োজন বোধ করেন না। এসবই একটি অনুন্নত সংস্কৃতির লক্ষণ। যাঁরা খাদ্য ব্যবসায়ী, তাঁরা শুধুই মুনাফা দেখেন আর যাঁরা ভোজনরসিক তাঁরা খাদ্য গ্রহণ ছাড়া আর কোনো দিকে তাকান না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে খাদ্য পরিবেশনের রীতিনীতিও এই সংস্কৃতির অংশ।

যা-ই হোক, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাঙালি মুসলমানদের প্রধান বিনোদন অতিরিক্ত তেলসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, যার সঙ্গে গরু এবং খাসির মাংস যুক্ত থাকে। আজকাল অতিগুরুপাক হাঁসের মাংসও যুক্ত হয়েছে। এমনকি অতিনিরীহ পাখি কবুতরও প্রিয় খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু এই সব খাদ্য বাংলার উষ্ণ আবহাওয়া একেবারেই স্বাস্থ্যপ্রদ নয় এবং যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষের জন্য উপযোগী খাদ্য রয়েছে যেমন শাকসবজি, বিভিন্ন ধরনের ডাল, মাছ, ফল এবং দধির মতো স্বাস্থ্যপ্রদ খাবার। 

কিন্তু যে বিষয়টির চর্চা করলে মানুষ উন্নত প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়, সেই চর্চার স্থান কোথায়? জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতিচর্চার স্থান কোথায়? একুশের বইমেলায় প্রচুর জনসমাগম হয়। এ কথা সত্যি। কিন্তু বই কটা বিক্রি হয় এবং কী বই বিক্রি হয় তা কিন্তু আমাদের বিবেচনায় থাকে না। কিছু বই আছে মানুষের চিন্তাকে বিকশিত করে নতুন ভাবনার সৃষ্টি করে। আবার কিছু কিছু বই আছে, যেগুলো মানুষের মধ্যে কোনো মননের সৃষ্টি করে না; বরং চিন্তাকে একটা অতল অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। মজাদার কিছু বই একটা তাৎক্ষণিক আনন্দ দেয় বটে, কিন্তু তৈরি করে একটা ফাঁপা মানুষ। আমাদের দেশ কবিতার, গানের, ছবির, আখ্যানের, গল্পের, পালাগান, নাটকের দেশ। যার মধ্যে উৎকৃষ্ট মননও যুক্ত আছে। চারণ কবিদের পদচারণে এ দেশের মানুষ একদা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করত। আহার্য হিসেবে তারা গ্রহণ করত ন্যূনতম স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং বেঁচে থাকত শত বছর। আমরা কি একটা স্বপ্ন দেখতে পারি যে খাবারের ক্ষেত্রে আমরা জাতীয়তাবাদী হব এবং সংস্কৃতিচর্চার দিকে আমরা হব বাঙালি; মনে করব, ‘বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’!

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত