Ajker Patrika

প্রথাগত শাসন চান হেডম্যানরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক
আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২২, ১৬: ০৫
Thumbnail image

পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ (হিলট্র্যাক্ট রেগুলেশন) পুনর্বহাল চান মৌজাপ্রধান হেডম্যান ও পাড়াপ্রধান কার্বারিরা। এ জন্য গতকাল বুধবার পার্বত্য জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। বান্দরবানে জেলা হেডম্যান-কার্বারি কল্যাণ পরিষদ, খাগড়াছড়িতে জেলা হেডম্যান অ্যাসোসিয়েশন ও রাঙামাটিতে হেডম্যান-কার্বারিরা এই স্মারকলিপি দেয়।

বান্দরবানে জেলা হেডম্যান-কার্বারি কল্যাণ পরিষদের নেতারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও প্রথার মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা শাসিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। এখানকার কৃষ্টি-সংস্কৃতি, জীবনাচার, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে, পার্বত্য শাসনবিধি-১৯০০ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশের এক-দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। পার্বত্য চট্টগ্রাম তিনটি সার্কেল চিফ (রাজা), হেডম্যান-কার্বারি দিয়ে প্রথা অনুযায়ী চলে আসছে। কিন্তু এই ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে নতুন কোনো আইন এখানকার মানুষ মেনে নেবে না।

স্মারকলিপি সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়াসহ তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সনাতনী রীতি-প্রথা সংরক্ষণের জন্য ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন তৈরি করা হয়। কিন্তু ২০০৩ সালে হাইকোর্ট আইনটি ‘মৃত’ ঘোষণা করেন। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের দেওয়া রায়কে খারিজ করে পুনরায় ১৯০০ সালের রেগুলেশন কার্যকর ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। তবে আপিল বিভাগের ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে ২৫ অক্টোবর আব্দুল আজিজ নামে একজন রিভিউ আবেদন করে। এতে পার্বত্য এলাকার হেডম্যান-কার্বারিদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলের অধীনে সামাজিক প্রথা অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে রাঙামাটি (কাপ্তাই ও রাজস্থলী বাদে) চাকমা সার্কেল, বান্দরবান জেলা ও রাঙামাটির দুই উপজেলা নিয়ে বোমাং সার্কেল এবং খাগড়াছড়ি জেলা মং সার্কেল হিসেবে পরিচিত। সার্কেল প্রধান (সার্কেল চিফ) ‘রাজা’ হিসেবে বেশি পরিচিত। সার্কেলের মৌজাপ্রধানেরা হেডম্যান ও পাড়াপ্রধানেরা কার্বারি হিসেবে স্থানীয় দিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা সার্কেলের প্রথা অনুযায়ী বিচাল-সালিস ও জমি-ফসলের খাজনা আদায় করেন। এর একটা অংশ সরকারি কোষাগারে ও বাকি অংশ হেডম্যান-কার্বারিদের মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী বণ্টন করেন রাজা।

বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, গতকাল বেলা ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির কাছে স্মারকলিপি দেন বান্দরবান হেডম্যান ও কার্বারি কল্যাণ পরিষদের নেতারা। এ সময় কল্যাণ পরিষদের সভাপতি হ্লাথুহ্রী মারমা, সাধারণ সম্পাদক উনিহ্লা মারমা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মংনু মারমাসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বান্দরবান সার্কেলের হেডম্যান-কার্বারি কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও তারাছা মৌজার হেডম্যান উনিহ্লা মারমা বলেন, বান্দরবান বোমাং সার্কেলের অধীনে মোট ১০৯টি মৌজা ও প্রায় দেড় হাজার পাড়া রয়েছে। এসব মৌজায় একজন করে হেডম্যান ও পাড়ায় একজন করে কার্বারি আছেন। তাঁরা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন’ প্রথামাফিক স্থানীয় সালিস করেন। এ কারণে বান্দরবানের থানায় মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যা কম। প্রথা অনুযায়ী পাহাড়ি জনগোষ্ঠী হেডম্যান-কার্বারিদের খুবই মান্য করেন, তাঁদের নির্দেশনা মেনে চলেন। এটি একটি ঐতিহ্য। তাই ঐতিহ্য রক্ষা করা সময়ের দাবি।

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, গতকাল প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা হেডম্যান অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাসের কাছে এই স্মারকলিপি তুলে দেন হেডম্যান অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।

অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সভাপতি ও হাফছড়ি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান চাইথোয়াই চৌধুরী বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি ও প্রথা সংরক্ষণের জন্য আইনটি বলবৎ রাখতে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।’

এর আগে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা শতাধিক হেডম্যান-কার্বারি খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সামনে একত্র হন। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যায় তাঁরা। এ সময় হেডম্যান অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সভাপতি ও হাফছড়ি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান চাইথোয়াই চৌধুরী, সহসভাপতি ও জেলা পরিষদের সদস্য হিরন জয় ত্রিপুরা, সাধারণ সম্পাদক স্বদেশ প্রীতি চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক রণজিৎ ত্রিপুরা, সিএইচটি নারী হেডম্যান নেটওয়ার্কের সভাপতি জয়া ত্রিপুরা, আনেউ চৌধুরী নয়নসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন রাঙামাটির হেডম্যান-কার্বারিরা।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন-১৯০০ এর রিভিউর উদ্দেশ্য হলো, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী প্রগতিশীল চরিত্রকে ব্যাহত করা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বতন্ত্র পরিচয়, স্বকীয়তা, ঐতিহ্য, জীবনাচার ও মৌলিক অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করা, যা সংবিধানের পরিপন্থী।

স্মারকলিপি দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য রাঙামাটি হেডম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি চিং কিউ রোয়াজা, সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ভবতোষ দেওয়ান, সাধারণ সম্পাদক কেরোল চাকমা, যুগ্ম সম্পাদক থোয়াই অং মারমা, সাংগঠনিক সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমা, দপ্তর সম্পাদক দীপন দেওয়ান টিটুসহ অন্যরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত