Ajker Patrika

পাখির অধিকার

সাজিদ মোহন
Thumbnail image

বরগুনার সদর ইউনিয়নের কড়ইতলী গ্রামের এক প্রবাসী দেশে ফিরে দেড় একর জমিতে আম, জাম ও লিচুর বাগান গড়ে তোলেন। পাখির হাত থেকে ফল রক্ষায় বাগানমালিক গাছগুলো ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে ঢেকে দেন। জালের ভেতরে প্রবেশ করতে পারলেও 
আর বের হতে না পেরে আটকা পড়ে দিনের পর দিন মারা গেল অনেক পাখি।

শাহাজানপুরের নারিনা ইউনিয়নের এক কৃষক পাখির আক্রমণ থেকে খেতের ফসল রক্ষা করতে (পাখি মারতে) খেতে মাষকলাই ডালের সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে ছিটিয়ে দেন। কীটনাশক মেশানো শস্য খেয়ে মারা যায় ২৭টি ঘুঘু ও ৩টি কবুতর। খেতের বোরো ধান খাওয়ার অপরাধে দেড় শতাধিক বাবুই পাখির ছানা হত্যা করেছিলেন পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার সদর ইউনিয়নের এক কৃষক।

সারা দেশেই মোটামুটি এভাবে জেনেবুঝে প্রতিনিয়ত পাখি হত্যা করা হয়। পত্রিকা খুললে চোখে পড়ে এ রকম অসংখ্য ঘটনা। জীবন বাঁচাতে খাবার খেতে এসে উল্টো জীবন যায় শত শত পাখির। ফল ও ফসল বাঁচানো অবশ্যই জরুরি, কিন্তু সব ফল ও ফসল কি শুধু মানুষই খাবে? আর মানুষ ভুলে যায় পাখিরা যদি সাহায্য না করত, তাহলে এই পৃথিবীতে মানুষের বসবাস করাটাই দায় হয়ে পড়ত। খেত-খামার, বন-জঙ্গল, ফল ও ফুলের বাগানে অসংখ্য ছোট-বড় নানান জাতের পোকামাকড় গাছপালা খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। এসব পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গকে নিয়ন্ত্রণে রাখে পাখিরা। আদতে পাখি ছাড়া মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে বাধ্য। ইতিহাসে এমন উদাহরণ আছে। 

ষাটের দশকে চীনা গবেষকদের প্রতিবেদনে উঠে আসে, একটি চড়ুই পাখি বছরে ৪ থেকে ৫ কেজি শস্য খেতে পারে, সে হিসাবে ১০ লাখ চড়ুইয়ের খাবার বাঁচিয়ে প্রায় ৬০ হাজার ব্যক্তির খাদ্যের জোগান দেওয়া যেতে পারে। কৃষির আশু ক্ষতির কথা ভেবে, ১৯৫৮ সালে মাও সে-তুংয়ের নির্দেশে অসংখ্য চড়ুই নিধন করা হয়। জোরেশোরে প্রচারণা চালানো হয়। চড়ুই মারার উৎসবে মেতে ওঠে গোটা চীন।

‘স্প্যারো আর্মি’ কাজে লেগে যায়। ইতিহাসের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়! বিভিন্ন পদ্ধতিতে চড়ুই নিধন হতে থাকে। যেমন দীর্ঘ সময় ধরে খুব জোরে জোরে ড্রাম বাজাতেই চড়ুই উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়তে শুরু করে। ডিম ও বাসা নষ্ট করা হয়। জালে আটকা পড়ে অসংখ্য চড়ুই। বন্দুক দিয়ে গুলি করে মারা হয় বাকি চড়ুই পাখি। এসব পদ্ধতিতে ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’ নামে প্রচারণার মাধ্যমে চড়ুইশূন্য হয় চীন। 

ফলে পরের বছরগুলোতে স্বাধীনভাবে ফসলে হানা দেয় অজস্র ক্ষতিকর পোকা। পরিস্থিতি এমন হলো, সেই ফসল আর ঘরে তোলা গেল না। যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে ১৯৬১-৬২ সালে চীনে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। শুরু হলো মৃত্যুর মিছিল। মারা গেল প্রায় ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন মানুষ। টনক নড়ল দেশটির সরকারের। নিরুপায় হয়ে প্রকৃতিতে চড়ুই ফিরিয়ে আনতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু হলো চড়ুই আমদানি।

প্রকৃতির তথা ফুল-ফল-ফসলের জন্য আশীর্বাদ এই পাখিরা আবার মাঝে মাঝে ডেকে আনে কৃষকের সর্বনাশ। শুধু পাকা ফল ও ফসল নয়, শীতকালীন সবজি বা রবিশস্য চাষের সময় বীজ বপনের বেশ কয়েক দিন পরেও বীজ মাটির সঙ্গে মিশতে পারে না। মূলত এই বীজগুলো খেয়ে ফেলে পাখিরা। তাই বলে পাখি হত্যা! পাখি তাড়িয়ে ফল-ফসল রক্ষায় প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পদ্ধতি প্রচলিত আছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ফসল পাখি ও ইঁদুরের কবল থেকে রক্ষা করতে কাকতাড়ুয়া সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতি।

বিভিন্ন জায়গায় ফসলের খেতে পাখি ও ইঁদুরের উপদ্রব কমাতে অডিও ক্যাসেটের ফিতা ব্যবহার করেন কৃষকেরা। ওই ফিতা রোদে ঝলমল এবং বাতাসে পটপট শব্দ করায় পাখি ও ইঁদুর ভয়ে খেতের আশপাশে আসে না। লিচু, আম, জাম, জামরুল রক্ষায় গাছের ডালে টিনের বাক্স বেঁধে তৈরি করা হয় একধরনের বাদ্যযন্ত্র।

নির্বিচারে পাখি নিধন বন্ধে সুস্পষ্ট আইন আছে দেশে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—পাখিদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। যে ফল-ফসল আমরা শুধু আমাদের বলে দাবি করে আসছি, প্রকৃতপক্ষে সেসব ভোগ করার অধিকার কার কতটুকু? শুধু পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ নয়, খাদ্য সংগ্রহের জন্য নানা রঙের ফল ও ফুলে ভরা গাছপালায় পাখিরা ভিড় করে সব সময়। এই খাদ্য সংগ্রহ গাছ এবং মানুষের জন্য বিস্ময়করভাবে উপকারী। পাখিরা পাকা ফল খাওয়ার সময় বীজটিও খেয়ে ফেলে।

মলত্যাগের মাধ্যমে এসব বীজ নানা স্থানে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই বীজগুলো যদি পাখিরা না খেত, সব বীজ বড় গাছের নিচে পড়ত। হাজার হাজার গাছ জন্মাত। এসব গাছ না পেত আলো, না পেত বাতাস, না পেত পানি এবং না পেত বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনমতো জায়গা। শুকিয়ে মরে যেত। শুধু তা-ই নয়, অনেক ছোট ছোট বীজ পাখিদের কাদামাখা পায়ে অথবা পালকে আটকে যায়। এভাবে দূর দেশে পাখির সঙ্গে চলে যায় গাছের বীজ। 

আমাদের দেশে এমন অনেক বিদেশি গাছ আছে, যা পরিযায়ী পাখিরা নিয়ে এসেছিল বীজের মাধ্যমে। আমাদের দেশের অনেক গাছের বীজ পাখিরা নিয়ে গেছে বিদেশে। এভাবে একটি গাছের বীজ শুধু কয়েক মাইলের মধ্যে নয়, কয়েক হাজার মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ফুলের পরাগ সংমিশ্রণেও পাখিরা সবচেয়ে সক্রিয়। নানান রকম মৌটুসি, দুর্গা-টুনটুনি, ফুলঝুরি ইত্যাদি পাখি ফুলের ভেতর থেকে মধু বের করে খায়। মধু খাওয়ার সময় ফুলের কিছু রেণু ওদের মাথায় কিংবা পালকে কিংবা ঠোঁটের চারপাশে আটকে যায়। শরীরে রেণুমাখা পাখিটি যখন অন্য ফুলে গিয়ে বসে, তখন তার বয়ে আনা রেণু অন্য ফুলের রেণুর সঙ্গে মিশে ফল ফলানোর কাজে লাগে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত