Ajker Patrika

রাসায়নিক ছিল অবৈধভাবে

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
আপডেট : ০৮ জুন ২০২২, ১৩: ৪৭
রাসায়নিক ছিল অবৈধভাবে

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আলোচনায় উঠে এসেছে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড। ফায়ার সার্ভিস থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অনেকের ধারণা, এই রাসায়নিকের কারণেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই রাসায়নিক কীভাবে ওই ডিপোতে সংরক্ষণ করা হলো? রপ্তানি নীতিমালা অনুসরণ করে এই রাসায়নিক ওই ডিপোতে নেওয়া হয়েছে, নাকি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজে ডিপোর মালিক হওয়ায় কোনো ধরনের নিয়ম না মেনেই সেখানে সংরক্ষণ করেছেন?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত কোনো পণ্য রপ্তানির জন্য ডিপোতে নেওয়া হলে শুল্কায়নের জন্য ওই পণ্যের চালানের তথ্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হয়। কিন্তু বিএম ডিপোতে রাখা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বিএম কনটেইনার ডিপোতে কর্মরত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা গতকাল মঙ্গলবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রপ্তানির জন্য ডিপোতে নিয়ে আসা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আমাদের (কাস্টমস) অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমেও এই রপ্তানিযোগ্য রাসায়নিক সম্পর্কে কোনো তথ্য আমরা পাইনি।’

বিপজ্জনক পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম জেঞ্জারাস গুডস বা আইএমডিজি কোড আছে। এ কোডের আওতায় নয়টি ক্যাটাগরির পণ্যের একটি তালিকা রয়েছে। তাতে রাসায়নিক, বিস্ফোরক, বিপজ্জনক গ্যাস, দাহ্য তরল ও কঠিন পদার্থ, বিষাক্ত, তেজস্ক্রিয়, জারণ পদার্থ রয়েছে। এসব পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে সংরক্ষণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার নীতিমালা আছে আইএমডিজি কোডে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সংরক্ষণে এই নীতিমালাও মানা হয়নি। ডিপোতে ছিল না তাপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। ডিপোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও ছিল না পর্যাপ্ত।

একাধিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রথমে রপ্তানিকারক আমদানিকারকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়, কী পণ্য যাবে, কীভাবে যাবে, কখন পাঠানো হবে—চুক্তিতে এগুলো নির্ধারণ করা হয়। এরপর রপ্তানিকারক শিপিং লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন শিপিং লাইন দেখে কোন অফ ডকে, কোন কনটেইনার খালি আছে এবং কোন অফ ডক থেকে পাঠালে সুবিধা হয়। সেই অনুযায়ী শিপিং লাইন অফ ডক নির্ধারণ করে। এরপর  শিপিং  অর্ডারের  বিপরীতে পণ্যগুলো অফ ডকে নিয়ে আসা হয়। পণ্য চালান অফ ডকে নিয়ে আসার পর সেগুলো অ্যাসেসমেন্ট করে পণ্যগুলোর শুল্কায়ন করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এরপর শিডিউল অনুযায়ী, পণ্যগুলো অফ ডক থেকে সহজীকরণ করা হয়।

নিয়ম অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শিপিং অর্ডারের পর অফ ডকে প্রবেশের আগেই এক্সপোর্ট জেনারেল মেনিপেস্টের (ইজিএম) মাধ্যমে পণ্য চালানের বিস্তারিত তথ্য কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে চলে আসার কথা। বিএম কনটেইনার ডিপোতে রাখা আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়নি। যে কারণে ওই ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আছে সেটি জানা যায়নি। বিএম ডিপো এবং আল রাজী কেমিক্যাল উভয়ই স্মার্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান।

ডিপো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্ঘটনার রাতে সেখানে মোট ৪ হাজার ৩১৮টি কনটেইনার ছিল। এর মধ্যে ১ হাজারের বেশি কনটেইনার ছিল পণ্যবোঝাই। এগুলোর মধ্যে ২৭টি কনটেইনারে রাসায়নিক পদার্থ ছিল বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছে ডিপো মালিকপক্ষ। তারা বলছে, তাদের কাছে যে তথ্য আছে সে অনুযায়ী ডিপোতে ১৭টি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড কনটেইনার ছিল। এগুলো রপ্তানির জন্যই ওই ডিপোতে সংরক্ষণ করা হয়।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে কর্মরত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিএম কনটেইনার ডিপোতে কী পরিমাণ কনটেইনার আছে, তার তথ্য আমাদের কাছে নেই। এটি ডিপো কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবে। তারা আমাদের কাছে যে তথ্য দেয় আমরা সেই তথ্যই পাই। নিয়ম অনুযায়ী তারা (ডিপো কর্তৃপক্ষ) প্রতিদিনের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য আমাদের অবহিত করার কথা। বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ সেটি করত না।’

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছে বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ। স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থাকার বিষয়টি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানত।

ওই বিবৃতিতে বলা হয়, কনটেইনার ডিপোর মূল কাজ হলো দৈনিক ভিত্তিতে কনটেইনারের জন্য জায়গা ভাড়া দেওয়া এবং তা আদায় করা। এখানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের একটি অফিস আছে। তারা ডিপোতে আমদানি-রপ্তানি কাজে সার্বক্ষণিক তদারকি করে। তাদের অনুমতি ব্যতীত কনটেইনার তো দূরের কথা এক কেজি পণ্যও ডিপোতে প্রবেশ কিংবা বের করা অসম্ভব। এমনকি যেকোনো কনটেইনারের লক-আনলক করতেও তাদের অনুমতি প্রয়োজন হয়। ডিপোতে হাজার হাজার কনটেইনারের মধ্যে মাত্র একটি কনটেইনারে বিস্ফোরণ হওয়া রহস্যজনক। ডিপো কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চায়। 

সিসিটিভি ফুটেজে মিলবে অনেক প্রশ্নের উত্তর
কীভাবে বিএম কনটেইনার ডিপোতে প্রথম আগুনের সূত্রপাত ঘটে, তা এখনো জানা যায়নি। সিগারেটের আগুন নাকি অন্য কোনো উৎস থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে, সেটি তদন্ত করছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যেই এটি নাশকতা কি না, সেটি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এই প্রেক্ষাপটে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অগ্নিকাণ্ডের কারণ। কীভাবে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিসিটিভি ফুটেজ পেলেই এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। শুধু তা-ই নয়, এটি নাশকতা কি না, সেটিও উঠে আসবে সিসিটিভি ফুটেজে।

দুর্ঘটনা তদন্তে মাঠে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সহ-অধ্যক্ষ (প্রশিক্ষণ কেন্দ্র) মোনায়েম আহমেদ। সিসিটিভি ফুটেজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি সিসিটিভি ফুটেজের সার্ভার ডিপোর শেডের দোতলায় ছিল। আমরা সেখানে গিয়ে দেখেছি, সবকিছু পুড়ে গেছে। তিন দিন ধরে আমরা ফুটেজ নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছু পাইনি। হার্ডডিস্ক, অথবা মেমোরি কার্ড উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। আমরা শুনেছি, ওদের হেড অফিস থেকে মনিটর করা হতো। সেখানে সংরক্ষণ করা আছে কি না, আমরা নিশ্চিত নই। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা বলছে হেড অফিস থেকে দেখত। কিন্তু সেখানে তারা সংরক্ষণ করত না।’

আগুন নির্বাপণে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ডিপোর আইটি এক্সপার্টকে খুঁজছিলাম। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি হাসপাতালে আছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলে সিসিটিভি ফুটেজ সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে পারতাম।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত