Ajker Patrika

সক্রিয় নকল দুধের চক্র

ওয়াহিদুজ্জামান, বেড়া (পাবনা) 
সক্রিয় নকল দুধের চক্র

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার পার-করমজা গ্রামের আলাউদ্দিন (৪০) মালয়েশিয়ায় শ্রমিকের কাজ করতেন। ১০ বছর প্রবাসজীবন শেষে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন গরুর খামার। প্রথম তিন-চার বছর বেশ ভালোই কাটছিল তাঁর। তবে এখন আয়-ব্যয়ের হিসাব না মিলাতে পেরে তাঁর খামারের গরুগুলো বিক্রি করে আবার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ চিত্র বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলার গরুর খামারিদের।

খামারিরা বলছেন, উচ্চমূল্যে গো-খাদ্য কিনে এই এলাকার খামারিরা লোকসানের মধ্যে রয়েছেন। অপরদিকে দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিরা বলছেন, দুগ্ধজাত পণ্যবিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের বিক্রয় মূল্য বাড়ালেও ক্রয়মূল্য বাড়াচ্ছে না। ফলে তাঁরা দুগ্ধ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সে কারণে খামারিরা গরু পালন করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে কমে গেছে দুধের উৎপাদন। এ সুযোগে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে নকল দুধ উৎপাদনকারী চক্র।

সম্প্রতি বেড়ার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের পেঁচাকোলা গ্রামে অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন। অভিযানে নকল দুধ উৎপাদন কাজের যন্ত্রপাতি ও বিপুল পরিমাণ দুধ তৈরির উপকরণসহ সঞ্জয় ঘোষ নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিজু তামান্না ওই নকল দুধ তৈরির কারখানার মালিককে ১ লাখ টাকা জরিমানা ও দেড় বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন।

খামারি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেড়া, পাবনার সাঁথিয়া, ফরিদপুর, চাটমোহর ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া অঞ্চল নিয়ে ‘বাঘাবাড়ী দুগ্ধ অঞ্চল’ হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলের মানুষ গরু পালনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ অঞ্চলের দুধের গুণগত মান ভালো হওয়ায় মিল্কভিটার পাশাপাশি দেশীয় দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে তাদের সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অফিসের তথ্য মতে, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রতিদিন প্রায় ১৪ লাখ লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। যার তিন ভাগের দুই ভাগই এই বাঘাবাড়ী কমান্ড এরিয়ার মধ্যে। মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিদিন খামারি ও দুগ্ধ ব্যবসায়ীদের (ঘোষ) কাছ থেকে গড়ে ছয় থেকে সাত লাখ লিটার দুধ কেনেন। বাকি দুধ এখানে গড়ে ওঠা শত শত ছানা তৈরি কারখানা ও দেশের বিভিন্ন মিষ্টান্ন ভান্ডার কেনে।

এদিকে দুধের উৎপাদন কমে যাওয়ায় একটি অসাধু চক্র নকল দুধ তৈরিতে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নকল দুধ প্রস্তুতকারীরা ছানা তৈরি কারখানা থেকে উচ্ছিষ্ট ছানার পানি কিনে নিয়ে যান। তাঁরা এই ছানার পানির মধ্যে সয়াবিন তেল, রং ও অন্য কেমিক্যাল মিশিয়ে অবিকল নকল দুধ তৈরি করেন। সেগুলো তাঁরা বিভিন্ন কোম্পানিতে সরবরাহ করছেন।

আর এসব দুধ ল্যাকটোমিটারে নকল দুধ হিসেবে ধরা না পড়ায় কোম্পানির মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

নকল দুধের বিষয়ে বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান পিউরী ডেইরি মিল্ক লিমিটেড ব্যবস্থাপক মানিক হোসেন জানান, এমন পদ্ধতিতে নকল দুধ তৈরি করা হচ্ছে, যা সাধারণ পরীক্ষায় শনাক্ত করা সম্ভব নয়। যদি নকল দুধ ধরা পড়ে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী উৎকোচের বিনিময়ে তা কিনে নেয়। ফলে নকল দুধ তৈরি বন্ধ হচ্ছে না।

মিনা ডেইরি ফার্মের মালিক মাহফুজা খাতুন মিনা বলেন, তিনি স্থানীয় একটি কোম্পানির ক্রয় কেন্দ্রে নিয়মিত দুধ সরবরাহ করতেন। তবে তিনি এখন তাঁদের কাছে দুধ বিক্রি করছেন না। তিনি আরও বলেন, কোম্পানিগুলো ফ্যাট মেপে ৪২ থেকে ৪৫ টাকার বেশি দাম দেন না। অথচ তিনি সেই দুধ খোলা বাজারে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। তাঁর মতে, সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলো যদি দুধের ক্রয়মূল্য না বাড়ান, তবে এ অঞ্চলের দুগ্ধ শিল্পের সংকট কাটবে না।

বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সবুর আলী বলেন, নকল দুধ উৎপাদনে উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এর আগে বেশ কয়েকজনকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি একজনকে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত