Ajker Patrika

নাম দিয়ে চেনা না-চেনা

মযহারুল ইসলাম বাবলা
নাম দিয়ে চেনা না-চেনা

আমাদের দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের নামকরণে প্রচুর মানুষের নামের অগ্রভাগে মোহাম্মদ থাকে। আরব দেশগুলোয় ব্যক্তির নামের অগ্রভাগে মোহাম্মদ দেখা যায় না। মোহাম্মদ একটি পূর্ণাঙ্গ নাম হিসেবেই তারা গণ্য করে। ইরাকে থাকার সময়ে জনৈক ইরাকি আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আমাদের সবার নামের অগ্রভাগে মোহাম্মদ কেন? আমি সদুত্তর দিতে পারিনি। তবে বিশ্বের প্রায় সব দেশে ব্যক্তির নামের অগ্রের নামটিকেই মূল নাম হিসেবে গণ্য করা হয়, মাঝের বা শেষেরটি নয়। কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ে নয়, উপমহাদেশের হিন্দু-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের নামও ধর্মীয় উৎসব-পার্বণ এবং ধর্মীয় দেবতা-যাজকদের নামানুসারে রাখার নজির রয়েছে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ ব্যক্তি-নাম সম্প্রদায়গত এবং জাত-বর্ণ পরিচয়ে। অনেকের নাম ধর্মীয় দেবতাদের নামানুসারে। যেমন হরিপদ, বিষ্ণুপদ, ইন্দ্রজিৎ, রামপ্রসাদ, ঈশ্বরচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন, নারায়ণ, বিষ্ণু-প্রিয়া, দুর্গাদাস, লক্ষ্মীকান্ত, শিবশঙ্কর, মহাদেব, শিবানী, গণেশ, কালী, দুর্গা, ইন্দ্র, কার্তিক ইত্যাদি। বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমদের নাম দিয়েই তাদের সম্প্রদায়গত পরিচয় নির্ধারণ করা যায়।

ইতিহাসের বীরদের নামানুসারে নাম রাখার এবং বর্জনের ঘটনাও রয়েছে। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর উপমহাদেশে জন্ম নেওয়া কারও নাম মীর জাফর রাখার একটি দৃষ্টান্তও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীকরূপেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশ্বাসঘাতকমাত্রই মীরজাফর। কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করলে তাকে মীরজাফর বলে তিরস্কার করা হয়। একইভাবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কারও নাম গোলাম আযম রাখার নজিরও কিন্তু নেই।

ব্যক্তিকে চিহ্নিত বা শনাক্তের সহজ উপায় হচ্ছে তার নাম। নামের আতঙ্কে রাজনীতিক, লেখক-সাহিত্যিকেরা রাষ্ট্রীয় রোষ থেকে রক্ষায় ছদ্মনাম ব্যবহার করতে বাধ্য হন। আমাদের উপমহাদেশে মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নেওয়া অনেক রাজনীতিক ও লেখক আদি নাম আড়াল করে ছদ্মনাম ধারণে বাধ্য হয়েছিলেন। চলচ্চিত্রের তারকারা সর্বাধিক সংখ্যায় ছদ্মনাম ধারণ করে থাকেন। নিজেদের সেকেলে নাম পাল্টে অত্যাধুনিক এবং নজরকাড়া নাম নিয়ে দর্শকের মন জয়ের অভিযানে নামেন। একসময় নানা সংগত কারণে ছদ্মনাম ধারণ অপরিহার্য ছিল। কিন্তু এখন সেটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যক্তির নামকরণে আমরা সর্বাধিক আরবি-ফারসি ভাষার ওপর নির্ভর করি। এই প্রবণতা কী পরিমাণ বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল কুয়েত বিমানবন্দরে। ১৯৮১ সালে ঢাকা থেকে বিমানে দুবাই হয়ে কুয়েত গিয়েছিলাম। আমার গন্তব্য ইরাকের রাজধানী বাগদাদ। ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণে ইরাক ভূখণ্ডে যাত্রীবাহী বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় কুয়েত থেকে সড়কপথে বাগদাদ যেতে হয়েছিল। কুয়েত বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে দুজন বাংলাদেশি কর্মজীবীর প্রতি ইমিগ্রেশনের লোকদের বিরূপ আচরণে আগ বাড়িয়ে তাদের প্রশ্ন করলে, আমার নাগরিক পরিচয় জেনে তারা বলে, ‘তোমার এই স্বদেশিদের নাম জিজ্ঞেস করছি অথচ উত্তর দিচ্ছে না।’ আমার স্বদেশিরা বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা জানে না বলেই সমস্যার সূত্রপাত। ইমিগ্রেশনের লোকদের বলি, আমি তোমাদের সাহায্য করব, কী প্রশ্ন বলো। তারা কাছের জনের নাম জিজ্ঞেস করল। আমি তাকে নাম বলতে বলি। সে বলে, মোহাম্মদ জামাল মিয়া। শোনামাত্র ইমিগ্রেশনের লোকদের রাগ-ক্ষোভ মুহূর্তে উধাও। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসির কারণ জানতে চাইলে বলে, ‘পাসপোর্টে ইংরেজিতে এই নাম দেখে আমরা অবাক হয়েছিলাম। চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ওদের মুখ থেকে শুনতে চেয়েছি। হাসতে হাসতে বলে, ‘জামাল অর্থ উট এবং মিয়া অর্থ এক শ।’ অর্থাৎ ব্যক্তিটির নাম আরবি ভাষান্তরে এক শ উট। এবার অপরজনের পালা। তাকে তার নাম বলতে বললে সে বলে, তার নাম মোহাম্মদ তারিক মিয়া। শুনে এবারও ওরা অট্টহাসিতে একে অপরের সঙ্গে তীব্র রসিকতায় মেতে ওঠে। এবার আর হাসির কারণ জিজ্ঞেস করতে সাহস পাইনি। তারা নিজেরাই বলে, ‘তারিক অর্থ রাস্তা আর মিয়া অর্থ এক শ।’ আরবি ভাষান্তরে তারিক মিয়া হচ্ছে এক শ রাস্তা। অপ্রস্তুত আমি দ্রুততায় সৌজন্য বিনিময় শেষে স্থান ত্যাগ করি। কুয়েত ইমিগ্রেশনের লোকদের হাসি-বিদ্রূপ অসংগত-অমূলক ছিল না। জামাল কিংবা তারিক বাংলা শব্দ নয়, আরবি। বাছ-বিচার না করে ধর্মীয় বিবেচনায় ওই দুজনের নাম আরবি ভাষায় রাখায় বিড়ম্বনাময় হয়েছিল আরবিভাষী দেশেই। ফারসি ভাষার ‘সেলিম’ উপমহাদেশের অনেকেরই এ নাম রয়েছে। অথচ ইরাকের আরবিভাষীরা কুকুরকে সেলিম বলে থাকে।

আরব্য রজনীখ্যাত আলিবাবা উপাখ্যান আমাদের উপমহাদেশজুড়ে বহুলপঠিত এবং জনপ্রিয়। আলিবাবাকে আমরা ব্যক্তির নাম বলেই গণ্য করে এসেছি। হতদরিদ্র বিনয়ী এবং কায়িক পরিশ্রমে সে জীবিকা নির্বাহ করে। তার প্রতি আমাদের প্রচুর সহানুভূতি। অপর দিকে আলিবাবার ভাই বদরাগী-অহংকারী কাশেম এবং ডাকাত সরদারকে কাহিনির খল চরিত্ররূপে বিবেচনা করে থাকি। তাদের দুজনের পরিণতিতে দুঃখিত না হয়ে স্বস্তি পেয়েছি। আলিবাবা চরিত্রটিকে ইতিবাচক রূপেই আমরা যুগ-যুগান্তর ধরে গণ্য করে এসেছি। অথচ উপাখ্যানের রচয়িতা উপাখ্যানের নামকরণেই নির্ধারণ করে গেছেন চরিত্রটিকে; ভাষার কারণে যা আমাদের অজানা রয়ে গেছে। আলিবাবা ব্যক্তির নাম নয়, আরবি ভাষায় আলিবাবা অর্থ চোর। আরবিভাষীরা চোরকেই আলিবাবা বলে।

আরবিভাষী মুসলিম-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠদের নাম ভাষাভিত্তিক। সে কারণে নাম দিয়ে তাদের সম্প্রদায়গত পরিচয় নির্ধারণ করা কঠিন। নিজেদের আরবি ভাষার অর্থপূর্ণ নাম তাদের দেখেছি। ব্যতিক্রম নিশ্চয় ছিল। অনেকের নাম জেনে মুসলিম ভেবে আলাপের পর জেনেছি, তিনি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের। সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তারিক আজিজ, যাঁর নামের বঙ্গানুবাদ সুন্দর পথ। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের নন, ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। এ রকম প্রচুর নজির দেখেছি। নাম দিয়ে ব্যক্তির সম্প্রদায়গত পরিচয় নির্ধারণ সেখানে দুরূহ।

আরব দেশগুলোয় বয়স্ক কাউকে নাম ধরে কেউ ডাকে না। আমাদের দেশেও পারিবারিক পরিমণ্ডলে এবং স্থানীয়ভাবে তেমন প্রচলন রয়েছে। আরবিভাষীরা ইউসুফের পিতাকে আবু ইউসুফ বলে ডাকে। আমাদের দেশে যেমন ইউসুফের বাবা বলে ডাকার প্রচলন রয়েছে। আবু সুফিয়ান, আবু জাহেল, আবু তালেব, আবু হামজা, আবু ওসমান ব্যক্তির নাম নয়, সন্তানদের নাম ধরে তাদের ওই সব নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের অনেকের নাম আবু সাঈদ, আবু হাসান, আবু বকর ইত্যাদি নামের আগে আবু ব্যবহৃত হয়ে থাকে বলে আরবিতে নামের অর্থ সাঈদের বাবা, হাসানের বাবা, বকরের বাবা।

আমরা সব ক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে নামের আগে জনাব ব্যবহার করে থাকি। জনাব ফারসি শব্দ। বঙ্গানুবাদে মহাশয় এবং ইংরেজি ভাষান্তরে মিস্টার। ফারসি ভাষার প্রভাব উপমহাদেশে বহুকাল থেকেই প্রচলিত। নারীদের ক্ষেত্রে আমরা লিঙ্গান্তরে জনাবা সম্বোধনও করে থাকি। ফারসি শব্দ হলেও জনাবের বিপরীত শব্দ জনাবা নয়। ফারসি ভাষায় জনাবা শব্দের বঙ্গানুবাদ হচ্ছে পতিতা। নারীদের সম্মান দিতে গিয়ে অজ্ঞতায় চরম অপমান করে থাকি।

রুশভাষীমাত্র প্রত্যেকের নামে ইংরেজির ঠ বা বাংলার ভ আমরা দেখে থাকি। যেমন লেভ তলস্তয়, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, গর্বাচেভ, ব্রেজনভ, শারাপোভা ইত্যাদি। ঠ বা ভ রুশ ভাষাভিত্তিক বলেই সব সম্প্রদায়ের রাশানদের ব্যক্তির নামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। রুশভাষী মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তির নাম আরবি-ফারসি ও রুশ ভাষার মিশেল। সে কারণে মুসলিমদের নাম—করিমভ, রহিমভ, ইব্রাহিমভ, ইলিয়াসভ, ইব্রাহিমোভিচ ইত্যাদি। আমাদের উপমহাদেশ ভিন্ন অন্য কোথাও ভাষাভিত্তিক নাম দেখে সম্প্রদায়গত পরিচয় নির্ধারণ সহজ নয়। রুশভাষীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের নাম মাতৃভাষাভিত্তিক। ব্যক্তির নামকরণে মাতৃভাষাভিত্তিক হওয়া কেবল জরুরি নয়, অপরিহার্যও বটে। 

মযহারুল ইসলাম বাবলা, নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

পিটুনিতে নিহত সেই শামীম মোল্লাকে বহিষ্কার করল জাবি প্রশাসন, সমালোচনার ঝড়

চিন্ময় দাসের জামিন স্থগিতের আবেদন, শুনানি রোববার

মধুপুরে বিদ্যালয়ে ঢুকে শিক্ষককে জুতাপেটা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত