Ajker Patrika

কণ্ঠযোদ্ধাকে বিনম্র শ্রদ্ধা

আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২: ০১
কণ্ঠযোদ্ধাকে বিনম্র শ্রদ্ধা

ফেসবুকের দেয়ালে ছবিটা দেখে হঠাৎ করে চোখ আটকে গেল। ক্যাপশন পড়ে স্থির হয়ে গেলাম। করোনা আক্রান্ত কবি কাজী রোজী আর নেই। মানুষটার সঙ্গে এক দিনের পরিচয়। আড্ডা মাত্র দু-তিন ঘণ্টার। তবু মনের মধ্যে তিনি ছাপ ফেলে দিয়েছিলেন। সেই ছাপ হয়তো আজীবন মুছবে না।

থেকে থেকে মনে পড়ছে কবির কথা। তখন সাংবাদিকতার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আমি। ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের জন্য কারও সাক্ষাৎকার নিতে হবে। সেই কেউটা হতে হবে খ্যাতনামা কেউ। ক্লাসের সবাই যার যার মতো বিখ্যাত কাউকে খোঁজা শুরু করল। কারও সঙ্গে যেন কারও না মেলে, সে জন্য তৈরি করা হলো তালিকা। আমি বহু কষ্টে জোগাড় করেছিলাম কাজী রোজীর ঠিকানা। এক বড় ভাই সাহায্য করেছিলেন। কবির সঙ্গে পরিচয় থাকায় তিনি আগেই কবিকে বলে রেখেছিলেন আমার কথা।

গ্রীষ্মের এক সকালে হাজির হয়েছিলাম কবির ধানমন্ডির বাসায়। বড় বৈঠকখানায় ঢুকতেই কবি এসে একটু অভিমান করে বললেন, ‘এত দেরি করলে কেন? আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি।’ আমি আর লজ্জায় বলতে পারিনি বাসা খুঁজতে গিয়ে দেরি হয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তেই হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘জানো, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় আমিও সেই তরুণ বয়সে আছি।’

যা হোক, আমার আর পুস্তকি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি তাঁর। আমরা পুরো সময়টাই আড্ডা দিয়েছিলাম। সেটা সহজ করে দিয়েছিলেন রোজী আপাই। এর পর থেকে আমি কখনোই কারও পুস্তকি বা ‘ফরমাল’ সাক্ষাৎকার নিতে পারিনি। আড্ডা দিয়ে গেছি সবার সঙ্গে। এই কৃতিত্ব যে রোজী আপার, সেটা আর তাঁকে বলা হলো না।

সেদিনের আড্ডাটা ভালোই জমেছিল; কবিতা আর গানের কথায়, একাত্তরের ঘটনায়। কবি কাজী রোজী ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারে কবিতা আবৃত্তি করে কতশত মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিকামী মানুষকে সাহস জুগিয়েছেন তখন! লিখেছেন গান, কবিতা, নাটক, আর জীবনী। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: পথ ঘাট মানুষের নাম, নষ্ট জোয়ার, ভালোবাসার কবিতা, প্রেমের কবিতা, মানুষের গল্প, খানিকটা গল্প তোমার, আমার পিরানের কোন মাপ নেই, লড়াই, শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা ইত্যাদি। কাজী রোজী প্রথম আলোর নারীশক্তি সম্মাননাসহ অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক। মুক্তিযুদ্ধের রাজাকার ও দোসরদের শাস্তির দাবিতে সংগ্রাম করেছেন বহুদিন। বন্ধু কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার দায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অনেক বছর কাজ করেছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। যুক্ত ছিলেন ডিসেবল রাইটস গ্রুপ, সাবা, লারা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে। তিনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়েও কাজ করেছেন বহু বছর।

মানুষটাকে দেখে সেদিন মনে হয়েছিল শত ঝড়-তুফানের মোকাবিলায় কঠিন একটা ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। অথচ হৃদয়টা শিশুর। অল্প সময়ের মাঝেই এমনভাবে আড্ডা জমিয়েছিলেন যেন আমি তাঁর কত দিনের চেনা বন্ধু।

গল্পে গল্পে বলেছিলেন, ‘জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খেতে পারিনি, সেই থেকে আমার সংগ্রাম শুরু। আমি একাত্তরে সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করেছি। কিন্তু অস্ত্র হাতে নিয়ে নয়। এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ আছে। তবে আমি ছিলাম শব্দসৈনিক। স্বাধীন বাংলা বেতারে আবৃত্তি করতাম।’

যুদ্ধ শুরুর আগে যখন মিরপুরে থাকতেন, তখন উর্দুভাষী অবাঙালিরা তাঁদের ওপর অত্যাচার করত। তখন কবি ও তাঁর মতো আরও অনেকে এসবের প্রতিবাদ করেছিলেন। সেসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাই হয়তো জন্ম দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের। বিহারিরা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। পাড়ার শহীদ মামা বাঁচিয়েছিলেন।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অধিদপ্তর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করার পর আবার ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংসদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে যোগদান করেছিলেন কাজী রোজী। সংসদে তিনি বাজেট নিয়ে নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। তাই প্রধানমন্ত্রী নাকি আবদার করেছিলেন তাঁর কাছে, সব সময় যেন তিনি কবিতা লিখে যান।

মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তিনি অনেক বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলেন। নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন সাহিত্যে আর সংসদে, কখনো প্রতিবন্ধীদের মাঝে, আবার কখনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সঙ্গে। এটাই ছিল তাঁর ক্যানসারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রেরণা। কবি আজও বেঁচে আছেন নিজ কর্মের মধ্যে। তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত