Ajker Patrika

সরকারি কলেজ যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে

রবিউল আলম, ঢাকা
আপডেট : ০২ জুন ২০২২, ০৮: ৩৯
Thumbnail image

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত সরকারি ও বেসরকারি কলেজগুলোয় পড়াশোনার মান এবং সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক অভিযোগ আসতে থাকায় সরকার আবার সরকারি কলেজগুলোর নিয়ন্ত্রণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছেই ফিরিয়ে দিচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক গত মঙ্গলবার বলেছেন, ‘এখন সারা দেশে এত সরকারি কলেজ যে সেগুলো ঢাকা থেকে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রধানমন্ত্রী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন কলেজগুলোকে স্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার। এটাকে লক্ষ্য রেখেই প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে জেলা পর্যায়ে আরও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করছেন। তিনি বলেন, ‘সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসলে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি কলেজগুলোর শিক্ষার মান তদারক করতে পারবে।’ ঢাকা কলেজ নিয়ে সরকারের মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে বলেও জানান তিনি।

দক্ষ শিক্ষকের অভাব, নিয়মিত ক্লাস না হওয়া, কাজে লাগানোর অনুপযোগী শিক্ষাক্রম, নামমাত্র পরীক্ষা নেওয়া এবং একপর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থীর অনিয়মিত হয়ে পড়াসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার মান কমে আসছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কয়েকটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অনেক শিক্ষার্থী বলছেন, তাঁরা ধুঁকছেন এখানে পড়ে। মোরশেদ আলম নোয়াখালী সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে।

শিক্ষাজটের কারণে চার বছরের স্নাতক (সম্মান) শেষ করেন সাত বছরে। স্নাতক শেষ হওয়ার পর থেকেই চাকরির জন্য চেষ্টা শুরু করেন তিনি। টানা ছয় বছর চেষ্টা করেও চাকরি নামের সোনার হরিণ জোটেনি। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘কেউই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের দাম দেয় না।'

মোরশেদ আলমের মতো সারা দেশে এমন লাখ লাখ শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আওতাধীন বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক অনেক দুর্বলতাসহ নানা কারণে পড়াশোনা ঠিকমতো করতে পারেননি। সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল হাই তালুকদার ক্লাস নিয়মিত না হওয়ার দায় ছাত্রদের বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সবাই ঠিকমতো ক্লাসে আসে। অনার্স পর্যায়ে তৃতীয় বর্ষ থেকে শিক্ষার্থী কমে যায়। আবার ক্লাসে তাঁদের উপস্থিতিও কমে যায়। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যদি না আসে, তাহলে শিক্ষকেরা কীভাবে ক্লাস নেবেন?

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) তাদের ২০২১ সালে প্রকাশিত এক জরিপে বলেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজগুলোয় শিক্ষার গুণগত মান ভালো নয়। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর অভিযোগ, স্নাতক শেষ করে চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। ইউজিসি ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেরোনো শিক্ষার্থীদের মান ভালো নয়।

এ অবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজগুলোয় পড়াশোনা ঢেলে সাজানোর কথা ভাবা হয়। এ পরিকল্পনার আওতায় বেসরকারি কলেজগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রেখে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনার কথা বিবেচনা করছে। এসব কলেজের যেখানে শিক্ষার মান ভালো, সেখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা চালু রাখা হবে। বাকিগুলোয় উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত রাখা হবে। তবে এই কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের কাজের বাজার উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রযুক্তি সম্পৃক্ত নানা বিষয় যুক্ত করে কর্মমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হবে।

ইউজিসি ২০২০ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২ হাজার ২৫৭টি অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৩ জন। এটা দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত মোট শিক্ষার্থীর ৬৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। দেশে মোট সরকারি কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠান ৫৯৮টি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত অনেক সরকারি কলেজেও পদের তুলনায় শিক্ষক নেই। যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রশিক্ষণের অভাব প্রকট। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের অনেকেই অন্য পেশায় জড়িত বলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। শিক্ষক সংকট ও দক্ষ শিক্ষক না থাকায় ধুঁকছে অনেক কলেজ। নিয়মিত ক্লাস না হওয়া, নোট ও গাইড-নির্ভর লেখাপড়া এবং নামমাত্র পরীক্ষায় চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।

অন্যদিকে বেসরকারি বেশির ভাগ কলেজ আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষকদের বেতন-ভাতাই ঠিকমতো দিতে পারছে না। শিক্ষক-কর্মচারীদের নামমাত্র অঙ্কের বেতন দিতেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে। বেসরকারি বেশির ভাগ কলেজে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার একটি বড় কারণ যেনতেন উপায়ে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগ।

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন শিক্ষার্থীদের জন্য মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৭৪১ টাকা ৩০ পয়সা। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১ লাখ ৮৭ হাজার ৯০২ টাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৮ হাজার ৯৬২ টাকা। প্রযুক্তি ও কারিগরি পাঠ্যক্রমই প্রধান, এমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রপ্রতি ব্যয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অন্তত চারগুণ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত কলেজগুলোয় শিক্ষার মান কম কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, অনার্স কলেজে তিন-চারজন শিক্ষক দিয়ে একটা বিভাগ চললে শিক্ষার মান নিম্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে বেসরকারি কলেজগুলো অঙ্গীকার করেছে তারা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কলেজ চালাবে। কিন্তু তারা শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতনও দেয় না।

স্নাতক পর্যায়ের সাধারণ কলেজগুলো আগে ঢাকা, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। ১৯৯২ সাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এসব কলেজের শিক্ষাক্রম তৈরি, পরীক্ষা নেওয়া এবং সনদ প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত