Ajker Patrika

পড়ার চাপ, প্রযুক্তিনির্ভরতায় সাংস্কৃতিক চর্চায় ভাটার টান

শরীফ নাসরুল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৪, ১০: ৫২
পড়ার চাপ, প্রযুক্তিনির্ভরতায় সাংস্কৃতিক চর্চায় ভাটার টান

সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন মেয়ে স্কুলে পড়ার সময় গান শেখানোর জন্য শিক্ষক রেখেছিলেন। মেয়ের কয়েক বছরের ছোট ছেলে এখন স্কুলে পড়লেও তাকে গান শেখানোর ব্যবস্থা করেননি। কারণ হিসেবে জানালেন, এ সময়ে মধ্যবিত্ত একটি পরিবার সংসার ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও অনেক পরিবারকে সাংস্কৃতিক চর্চার খরচ ছেঁটে ফেলতে হয়েছে।

কেবল জসিম উদ্দিন নন, মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই এখন স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের গান, নাচ শেখানো থেকে সরে এসেছে। অথচ এটি একসময় বাঙালি উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে চল ছিল। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল সাংস্কৃতিক চর্চার আঁতুড়ঘর। সময় পরিক্রমায় এতে ক্রমে ভাটা পড়েছে। ঘরে ঘরে সাংস্কৃতিক চর্চার সেই দিন আর নেই। নেই গান, নাচ, আবৃত্তিসহ সাংস্কৃতিক চর্চা শেখানোর শিক্ষক আর শিক্ষালয়ের কদর। এ কারণে কমছে সংখ্যাও।

সাংস্কৃতিক চর্চায় কেন এই ভাটা– এমন প্রশ্নের উত্তর একেকজনের একেক রকম। তাঁদের মতে, ক্যারিয়ারের চিন্তার কারণে পড়ালেখায় মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা, আর্থিক সংকট, তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতায় জীবনধারায় পরিবর্তন, কেবল টিভির কারণে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকে পড়া, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব, স্থানীয় সস্তা ও মানহীন বিনোদন, বিনোদনের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা এবং প্রজন্মের ব্যবধান ঘরে সাংস্কৃতিক চর্চায় ভাটা পড়ার কারণ।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান ও অভিনেত্রী লাকী ইনাম বলেন, ‘আমাদের সময়ে পড়ালেখার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চা হতো। কিন্তু এখন অভিভাবকেরা পড়ালেখার বাইরে এগুলো চর্চার প্রয়োজন মনে করছেন না। সাংস্কৃতিক চর্চাবিরোধী মানসিকতাও বাড়ছে। তবে আমি আশাবাদী, সাংস্কৃতিক চর্চায় আবার জোয়ার আসবে। কারণ, অনেক তরুণ মা-বাবাকে বুঝিয়ে থিয়েটার করছে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি করছেন।’

অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের সময়ে স্কুল ছুটির পর সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়ার চাপ তেমন থাকত না। সেই অবসরে গান-নাচ শেখা বা খেলাধুলা চলত। কিন্তু এখন তো বাচ্চারা স্কুল-কোচিং-ব্যাচে পড়ে ঘরেই ফেরে অনেক দেরিতে। ঘরে ফিরেও পড়তে হয়। সাংস্কৃতিক চর্চার সময় কোথায়? আবার জীবনের সব ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার এই সময়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়াই মা-বাবার মূল ভাবনা। ফলে এদিকেই সন্তানদের তাঁরা ব্যস্ত রাখছেন। এসবের পেছনে খরচের পর পরিবারের হাতে বাড়তি টাকাও থাকছে না। সন্তানেরা যেটুকু সময় পাচ্ছে—বুঁদ থাকছে মোবাইল বা কম্পিউটারে গেমস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সময় ও বাস্তবতাই ভাটা এনেছে পারিবারিক সাংস্কৃতিক চর্চায়।

ব্যবসায়ী মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আশি ও নব্বই দশকে খেলাধুলা, গান, নাচের চর্চার সময় ছিল, সুযোগও ছিল। কিন্তু এখন অভিভাবকেরা ক্যারিয়ারের ভাবনায় শিশুদের শৈশবই নষ্ট করে দিয়েছেন। এক্সট্রা কারিকুলাম নয়, বাচ্চাদের পড়ালেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছেন। এটা বাস্তবতাও। অথচ আমরা অনার্স পরীক্ষা দেওয়ার পর চাকরি নিয়ে ভেবেছি।’

রাজধানীর সেন্ট যোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলার শিক্ষক এবং সংগীতশিল্পী বিদ্যুৎ সরকার বলেন, ‘সারা দেশের দিকে তাকালে বলাই যায় সাংস্কৃতিক চর্চা কমছে। তবে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।’

অনেকে বলছেন, গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও ‘অবসর’ বলে একটা সময় ছিল। কিন্তু এখন তা নেই। মানুষ কেবল ছুটছে। সাংস্কৃতিক চর্চা কমার ক্ষেত্রে এরও প্রভাব আছে। এমন কথাই বললেন মঞ্চ ও টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, জীবন এখন গতিশীল। শেখা অনেক সহজ হয়ে গেছে প্রযুক্তির কারণে। স্মার্টফোন ও কম্পিউটারে শিখছে। এ জন্যই এখন আর বাসায় হারমোনিয়াম, তবলা দেখা যায় না। পাড়ায় পাড়ায় ছবি আঁকা, গান-নাচ শেখানোর স্কুল ও শিক্ষক এখন নেই।

তবে সাংস্কৃতিক চর্চায় ভাটার জন্য প্রজন্মের পছন্দ বদলকেও বড় কারণ বলছেন তরুণ নির্মাতা শিকড় হক চৌধুরী। তাঁর মতে, ১০-২০ বছর আগেও বিনোদনের মাধ্যম ছিল গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয়। কিন্তু এই প্রজন্ম স্মার্টফোনে বিনোদন খুঁজে নিয়েছে। গেমও একটা বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে।

নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, বড় শহরে ভালো লাইব্রেরি, মিলনায়তন ও সিনেমা হল নেই। কিন্তু খাবারের দোকানের অভাব নেই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ নেই। গ্রাম, মফস্বল শহর ও বড় শহরেও শিল্প-সাহিত্যের চর্চা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত